‘আমি যখন বাসায় উর্দু ভাষায় কথা বলি, তখন ছেলে আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, ও যেন কিছুই বুঝতে পারে না।’
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পর ভারতের বিহারের অধিবাসী মকবুল বাহার স্ত্রী, ছোটো দুই পুত্র ও এক মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশের সৈয়দপুরে চলে আসেন। নানা ঘটনার পর শেষমেষ পরিবারটির ঠাঁই হয় খুলনার খালিশপুরে অবস্থিত বিহারী ক্যাম্পে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েক বছর পর জনাব মকবুলের মেয়ে হালিমার বিয়ে হয় একজন বাঙালি পুরুষের সঙ্গে। বছর ঘুরতেই তাদের সংসারে আসে নতুন অতিথি। ধীরে ধীরে হালিমার সন্তান বড় হতে থাকে, স্কুলে পড়াশোনাও শুরু করে। হালিমা একদিন খেয়াল করেন, তার সন্তানকে উর্দু ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে বাংলা ভাষায় উত্তর দেয়। হালিমা জানান, যেহেতু তার সন্তান বেশিরভাগ সময় বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে মেশে, তার দাদাবাড়ির সবাই বাঙালি, সেহেতু খুব স্বাভাবিকভাবেই সে বাংলা ভাষায় বেশি পারদর্শী হয়ে উঠেছে।
খালিশপুর বিহারী ক্যাম্পের আরেক উর্দুভাষী বাংলাদেশি নাগরিক ওসমানেরও প্রায় একই অবস্থা। তিনি জানান, তার ছেলের বয়স এখন ১৫ বছর। অথচ এ বয়সেই সে উর্দু ভাষা প্রায় ভুলে গেছে। বলেন, ‘আমি যখন বাসায় উর্দু ভাষায় কথা বলি, তখন ছেলে আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, ও যেন কিছুই বুঝতে পারে না।’
খালিশপুরের বিহারী ক্যাম্পে ঘুরে ও এখানে বসবাসকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগের প্রজন্মের পথ ধরে উর্দুভাষী বাংলাদেশি নাগরিকদের বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা উর্দু ভাষায় কথা বলছে না। এ সময় কথা হয় আকরাম নামের এক কিশোরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে সারাদিন আমি দোকানে থাকি, আমার বেশিরভাগ কাস্টমারই (ক্রেতা) বাঙালি। আমি যাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই তারাও বাঙালি। যেকারণে কথা বলতে গেলে আমার মুখে উর্দু না এসে বাংলাই চলে আসে।’
এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীরা জানালেন, বিহারী ক্যাম্প এলাকায় উর্দুভাষী মানুষদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উপরন্তু তাদের ক্যাম্পের ভেতর বাংলা ভাষাভাষী পরিবারের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি বেড়ে গেছে। ফলে বিবাহ বন্ধন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই দুই ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ধীরে ধীরে তাদের ভাষা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে।
‘অভিবাসী ডটকম’ এর সঙ্গে আলাপচারিতার সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উর্দুভাষী একজন সরকারি চাকুরীজীবী ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ যুক্ত করলেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন অফিসে যাই, তখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করি প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে। আমি বুঝতে দিই না, আমি বিহারী, আমি উর্দুভাষী। কারণ খেয়াল করেছি, কোনো কারণে আমি যদি উর্দু ভাষায় কথা বলি, তাহলে আমার বাংলাভাষী সহকর্মীরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয় না। আমার মনে হয়, তারা উর্দু ভাষাকে ঘৃণা করে। যা আমার ভেতর হীনমন্যতার তৈরি করে। যেকারণে উর্দু ভাষায় কথা বলতে আমি অস্বস্তিবোধ করি।’
এসময় তিনি অবশ্য তার সহকর্মীদের ওপর মোটেও নাখোশ নন বলে সাফ জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা করার ওপর জোরাজুরি করেছিল, এদেশের মানুষের মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে এদেশের মানুষ পথে নামতে বাধ্য হয়, জীবনের বিনিময়ে তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে এদেশের সাধারণ মানুষ যদি আমাদের ভাষা উর্দুকে গ্রহণ করতে নারাজ থাকে, তাহলে আমি দোষের কিছু দেখি না। তবে দুঃখ হলো, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অন্যায্য ও অযৌক্তিক ওই আচরণের দায়ভার আমাদের বহন করতে হচ্ছে।’
চারটি ভাষা চর্চা করতে হয় তাদের
যদিও বিহারী ক্যাম্পে বসবাসরত উর্দুভাষী বাংলাদেশিদের মধ্যে আলাদা করে নিজেদের ভাষা চর্চা ও প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে চাক্ষুষ কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। উল্টো অনেকেই তাদের শিশু সন্তানদের উর্দু ভাষা শিক্ষা না দিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় আরবি শিক্ষার জন্য ভর্তি করেছেন। এমনকি নিজেরাই ছোটো পরিসরে মাদ্রাসা চালু করেছেন, যেখানে নানা বয়সী ছেলেমেয়েরা আরবি শিক্ষা গ্রহণ করতে আসে।
এরকম একটি মাদ্রাসা ‘আল-ফালাহ ফোরকানিয়া মাদরাসা’। গতকাল দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে দোচালা টিনের ছোটো একটি কক্ষে ঢুকতেই বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আরবি পড়তে দেখা গেল। আরবি শিক্ষা দেয়ার জন্য সেখানে একজন নারী শিক্ষকও নিয়োগ দিয়েছে মাদ্রাসাটির পরিচালনা কমিটি।
কমিটির অন্যতম সংগঠক শামিমুল বাহার জানালেন, একেবারে নিজেদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে মাদ্রাসাটি তারা চালু করেছিলেন। মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এখানে বসবাস করি, তারা সবাই মুসলমান, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও মুসলমান। আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা অন্তত সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করুক। এজন্য তাদের আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি।’
এপর্যায়ে কথা হয় একজন উর্দুভাষী অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিয়েশাদি দেয়ার সময় মেয়েরা যদি আরবি পড়তে পারে, কোরআন শরীফ পড়তে পারে তাহলে বিয়ে দেয়ার সময় তা কাজে লাগে। এজন্য আমি আমার মেয়েকে বাংলা-ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি আরবিও পড়াচ্ছি।’
খুলনার খালিশপুর ও ফেরিঘাটে অবস্থিত বিহারী ক্যাম্পগুলো ঘুরে ‘অভিবাসী ডটকম’ এর অনুসন্ধানে দেখা গেল, প্রতিদিন আসলে উর্দুভাষী একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটি চারটি ভাষা চর্চা করতে হচ্ছে। এরকমই একজন শিক্ষার্থী রাব্বি। রাব্বি খালিশপুরের একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। তার প্রতিদিনের পাঠ্য বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে সে বলে: ‘প্রতিদিন সকাল আটটায় স্কুলে যাই। সেখানে বাংলা ও ইংরেজিসহ অন্যান্য বিষয়ে পড়াশুনা করি। এরপর ফিরে এসে দুপুর তিনটায় আরবি পড়তে চলে আসি। সন্ধ্যার সময় বাসায় শিক্ষক ইংরেজি পড়াতে আসে।’ এছাড়াও তার পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ ও কথাবার্তার সময় রাব্বি উর্দু ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে।
উর্দু ভাষা রক্ষায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এর ভূমিকা কী
বিহারী ক্যাম্পে অবস্থানরতদের মাতৃভাষা উর্দু রক্ষায় ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য এখানকার অধিবাসীদের বক্তব্য, সরকার যদি এ বিষয়ে একটু মনোযোগ দেয় এবং তাদের ভাষা রক্ষায় উদ্যোগ নেয়, তাহলে তাদের জন্য যেমন ফলপ্রসু হবে তেমনিভাবে মাতৃভাষা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের উদারতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতের বিহারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বিপুলসংখ্যক উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মানুষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত হয় এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের অংশ হিসেবে তারা ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, বগুড়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ১১৬টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। একটা সময় যা কিনা তাদের স্থায়ী আবাসনে পরিণত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপাক্ষিক সিমলা চুক্তির আওতায় কিছু সংখ্যক উর্দুভাষী পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। বর্তমানে এসব ক্যাম্পে তিন লাখেরও বেশি উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাস।
মহামান্য হাই কোর্টের ২০০৩ ও ২০০৮ সালের দুইটি পৃথক রায়ে বাংলাদেশের উর্দুভাষী জনগণের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার আইনগতভাবে নিশ্চিত হয়েছে। তবে উর্দুভাষী বেশিরভাগ নাগরিকদের দাবি, কাগজে কলমে এদেশের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার অর্জিত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতো সুযোগ সুবিধা পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
রাতুল নামের এক উর্দুভাষী স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থী ‘অভিবাসী ডটকম’কে বলেন, ‘দেখুন, ঢাকায় বিশাল পরিসরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য প্রত্যেকটি মাতৃভাষাকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়া এবং উপযুক্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সবাইকে একত্রিত করা।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, মাতৃভাষাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি উর্দুভাষীদের ভাষা চর্চার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আদৌ কিছু করেছে কি?
এ বিষয়ে কথা বলতে ‘অভিবাসী ডটকম’ এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এর মহাপরিচালক মোঃ বেলায়েত হোসেন তালুকদারের সঙ্গে। কথার শুরুতেই তিনি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
এরপর যোগাযোগ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মোঃ শাফীউল মুজ নবীন এর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট তার ম্যান্ডেট অনুযায়ী সব মাতৃভাষার প্রতি সম্মান রেখে তা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখানে কোনো বিশেষ ভাষার প্রতি রাগ-অনুরাগ কাজ করার সুযোগ নেই।’
এ পর্যায়ে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্ব-ভাষা চর্চার বিষয়ে মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট আদৌ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তার উত্তর: ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানে দুই বছর যোগদান করেছি, এসময়ের মধ্যে হয়নি, আগেও হয়েছে বলে শুনিনি।’
এসময় তিনি অবশ্য জানান, যেকোনো ভাষার সংরক্ষণে কোনো প্রতিষ্ঠান এককভাবে কাজ করতে পারে না, একার পক্ষে কাজ করা সম্ভবও নয়। এক্ষেত্রে অনেককে এগিয়ে আসতে হয়। তবে সবার আগে এগিয়ে আসতে হয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে যেসব সচেতন মানুষ রয়েছেন, যারা নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় বদ্ধ পরিকর। তাদের আগ্রহ না থাকলে নিজ মাতৃভাষার রক্ষায় কোনো উদ্যোগই সফল করা সম্ভব নয়।
ইউনেস্কো বিশ্বের বিভিন্ন গোত্রের মাতৃভাষাকে বিপন্নতার শ্রেণিভুক্ত করতে কিছু সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড সংজ্ঞায়িত করে থাকে। সেখানে উল্লেখ আছে, একটি ভাষাকে তখন অরক্ষিত বলে মনে করা হয়, যখন বেশির ভাগ শিশুই সেই ভাষাটি শুধু কিছু নির্দিষ্ট স্থানে যেমন, বাড়ির ভেতরে চর্চা করে। একটি ভাষা অবশ্যই বিপন্ন হয়-যদি শিশুরা বাড়িতে মাতৃভাষা হিসাবে আর সেই ভাষা না শেখে, অর্থাৎ সবচেয়ে কম বক্তারা পিতামাতার প্রজন্মের হয়। ভাষাটি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়-যদি এটি শুধুমাত্র দাদা-দাদি এবং বয়স্ক প্রজন্মের মধ্যে চর্চা করা হয়। তাহলে কী উর্দুভাষী বাংলাদেশি নাগরিকদের মাতৃভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে?