শুক্রবার, 16 মে, 2025

শ্রম অভিবাসন কী এবং কেন: মৌলিক ধারণা (প্রথম পর্ব)

ছবি: লেখক

মানব সভ্যতার প্রারম্ভিককাল হতে নিজ, পরিবার, গোষ্ঠী বা সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘অভিবাসন’ হয়ে উঠেছিল নিয়মিত, যা বৈশ্বিক শ্রম বিন্যাস, যোগান, ও শ্রম চাহিদা অনুসারে এখনো চলমান।

প্রাচীনকাল বা মানব সভ্যতার শুরুতে অভিবাসন বা স্থানান্তরের মূল কারণ ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদন বা উর্বর কৃষি জমির পর্যাপ্ততা, কৃষিকাজের সহায়ক পানির উৎসের সহজলভ্যতা এবং দুর্যোগ ও বন্য প্রাণীর আক্রমণ হতে গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে যেসমস্ত প্রাচীন সভ্যতার সন্ধান পাই, তা সবই ছিল মনুষ্য অভিবাসনের ফল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে শিল্প বিপ্লবের সূচনার পর জাতি বা গোষ্ঠী হিসেবে নিজ রাষ্ট্রের গন্ডি পেরিয়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও ‘শ্রমিক’ হিসেবে মানুষের অভিবাসন বিশ্বব্যাপী তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায়।

মূলত: ভারী শিল্পের প্রসার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি ও নতুন নতুন স্থাপিত কলকারখানার জন্য শ্রমিক যোগান ও সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য ‘আধুনিক শ্রম অভিবাসনের’ সূচনা হয়। তৎকালে আমাদের দেশের মতো অনুন্নত ও দারিদ্র পীড়িত দেশ হতে উদ্ভাবন, সংস্কৃতি, শিক্ষায়, ও শিল্পে-বাণিজ্যে অগ্রগামী ও উন্নত দেশে অভিবাসন এক কথায় একমুখীই ছিল।

‘মনুষ্য অভিবাসন’ বা ‘শ্রম অভিবাসন’ অনেকটা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপর, যা ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার নিজের দেশ হতে (উৎস দেশ) নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দেশে (গন্তব্য দেশ) অভিবাসনে উৎসাহিত বা বাধ্য করে।’

এই ব্যাপক শ্রম অভিবাসনের ফলে একদিকে যেমন ভারী শিল্পে সমৃদ্ধ-বাণিজ্য নির্ভর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো, অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য-শোষণের মাত্রা এবং ধরণও বাড়ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যম ও ভারী শিল্পের শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের চাহিদা আবারও বেড়ে যায়, কিন্তু তখন শ্রম অভিবাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে রাষ্ট্র।

যদিও প্রথম কয়েক দশক অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিকরাই নিজস্ব তাড়না ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বেশি অভিবাসন করেছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আশির দশকে তেল বাণিজ্যের উন্নতির লগ্নে ব্যাপক শ্রমিক চাহিদার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়মিত অভিবাসনের ওপর গুরুত্ব দেয়া শুরু করে ও দেশের দরিদ্র পীড়িত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ব্যাপক পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস ও সুযোগ খুঁজে পায়। এ কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য শ্রম অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

শ্রম অভিবাসনের তাত্ত্বিক ধারণা:

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা পরিবেশগত কারণ ছাড়াও ‘মনুষ্য অভিবাসন’ বা ‘শ্রম অভিবাসন’ মানুষের চাহিদা ও নিজস্ব ধ্যানধারণার ওপরও নির্ভর করে। এভারেট লি’র মতে (১৯৬৬), ‘মনুষ্য অভিবাসন’ বা ‘শ্রম অভিবাসন’ অনেকটা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপরে, যা ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার নিজের দেশ হতে (উৎস দেশ) নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দেশে (গন্তব্য দেশ) অভিবাসনে উৎসাহিত বা বাধ্য করে।

কিছু নিয়ামক যেমন: নিজ দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি যা ‘পুশ ফ্যাক্টর’ নামে পরিচিত, আবার গন্তব্য দেশে অধিক আয়ের সুযোগ, কর্মের নিশ্চয়তা, উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ ইত্যাদি যা ‘পুল ফ্যাক্টর’ নামে পরিচিত- তার ওপর নির্ভর করে শ্রম অভিবাসন হয়ে থাকে।

গ্রাফিক্স: অভিবাসী ডটকম

আবার লীর তত্ত্ব অনুসারে, বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ও ভিসা প্রাপ্তির সহজলভ্যতা ও সুযোগ, উৎস দেশ ও গন্তব্য দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক, পছন্দনীয় নির্দিষ্ট দেশে অবস্থানরত বা কর্মরত ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা নেটওয়ার্ক ইত্যাদি কারণেও শ্রম অভিবাসন হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, বিখ্যাত গবেষক ডানকানের মতে, ‘শ্রম অভিবাসন’ যেসব নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে তা হলো: অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রসার, যোগাযোগ মাধ্যমের ও প্রক্রিয়ার উন্নতি, সামাজিক বিভিন্ন কারণ, পরিবেশগত বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও অন্যান্য ব্যক্তিগত (মনস্তাত্ত্বিক) কারণসমূহ।

আর এক গবেষক স্ট্যান্ডিং এর মতে, অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ও মাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে নিজ দেশ ও গন্তব্য দেশের দেশজ সম্পদ, উৎপাদনের মাত্রা ও পরিমান এবং সমাজে শ্রমের বিন্যাস ইত্যাদির ওপর ।

সুতরাং, ‘মনুষ্য অভিবাসন’ বা ‘শ্রম অভিবাসন’ শুধুমাত্র একমুখী নয়, বরং তা বিশ্বব্যাপী শ্রমের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জরুরি। এটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী করছে, অন্য দিকে অনুন্নত দেশগুলোকে মানবসম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দক্ষ জনশক্তি তৈরী করার পথ করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ হতে শ্রম অভিবাসনের কারণ ও ধরণ:

যদিও বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম অভিবাসনের সঠিক সময় বের করা কঠিন, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালেই (১৭৬০ হতে ১৯৪০ অব্দি) যে তার ব্যাপ্তি বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল থেকে ইংল্যান্ড ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পারিবারিকভাবে অভিবাসনের সময়কাল ও হার দেখলেই তা অনুমান করা সম্ভব।

কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে নথিভুক্ত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, বিশেষ করে ১৯৭৬ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি করার মাধ্যমে যা এখনো চলমান। সরকারি হিসেবে (বিএমইটির সূত্রমতে) ১৯৭৬ সাল হতে ২০২৩ (জানুয়ারী) পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৪৯ লক্ষ ৮৩ হাজার লোক বিশ্বের প্রায় ১৭৩টির অধিক দেশে অভিবাসন করেছে।

যদিও আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক হিসেবে দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পুরুষরাই (সরকারি উপাত্ত অনুসারে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নোয়াখালী ইত্যাদি জেলা থেকে বেশি শ্রম অভিবাসন হয়ে থাকে) বেশি অভিবাসন করে থাকে। বিপরীতে নারী অভিবাসনও কম নয়, প্রায় ৭.৫০% (সূত্র: বিএমইটি)।

দক্ষ, স্বল্প দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক অভিবাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পেশাভিত্তিক, শিক্ষানির্ভর (ছাত্র/ ছাত্রী হিসেবে) বা পারিবারিক অভিবাসন ও হয়ে থাকে। নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনের পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসন যে হয় না, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার গবেষণায় পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে (যেমন: টুরিস্ট হিসেবে, অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার মাধ্যমে, অননুমোদিত নৌপথে) ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, কিংবা এশিয়ার অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ অভিবাসন করে থাকে (তা বছরে প্রায় আনুমানিক ২০-৩০ হাজার)- যার নির্দিষ্ট ডাটা বা হিসেব আমাদের কাছে নেই।

গ্রাফিক্স: অভিবাসী ডটকম

আবার অন্যান্য সূত্র মতে, মানব পাচার ও এদেশ থেকে থেমে নেই। বাংলাদেশ হতে মূলত: ভারত হয়ে প্রতি বছর প্রায় কয়েক হাজার মানুষ (আনুমানিক ৬-৭ হাজার) পাচার হয়ে থাকে। শ্রমিক হিসেবে হোক বা পেশাদার গোষ্ঠী হিসেবেই হোক, বাংলাদেশ হতে মূলত: দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, সামাজিক নিরাপত্তা হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তন, পারিবারিক অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি, উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ, মেধাভিত্তিক দক্ষতার প্রয়োগ ও সৃজনশীল কাজের সুযোগের জন্যই অভিবাসন হয়ে থাকে।

লেখক: (উপদেষ্টা, বমসা), শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা