উন্নত জীবনের আশায় প্রতি মাসে হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করে। মূলত আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে আগত এই বিপুলসংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে মুসলমানও রয়েছেন।
ল্যাটিন আমেরিকার রুট ব্যবহার করে ছুটে চলা এসব মুসলিম অভিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার ঠিক নির্দিষ্ট হিসাব কারো কাছেই নেই। তবে এই অঞ্চলে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানসমূহ জানাচ্ছে, মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
যাত্রাপথে ভয়াবহ নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন এই মুসলিম অভিবাসীরা। দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্তিকর যাত্রার পাশাপাশি নেকড়ের হামলার শিকারও হতে হয় তাদের। তবে ভয়ঙ্কর এসব সংকটের মধ্যে একটি বিষয় তাদের জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহলো ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িক সহযোগিতা- যার কারণে বিপদসঙ্কুল চলার পথে অনেকটাই সাহস পাচ্ছেন এসব মুসলিম অভিবাসীরা। একইসঙ্গে নিজেদের ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রেও তারা অন্য ধর্মের মানুষদের কাছ থেকেও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাচ্ছেন।
গত কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ মুসলিম অভিবাসন প্রত্যাশী ও শরণার্থীরা ল্যাটিন আমেরিকার সাও পাওলো রুটটি ব্যবহার করছেন। প্রধানত তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর বাসিন্দা।
`আমার ধারণা ২০২০ সালে আমরা যতজন মানুষকে স্বাগত জানিয়েছি তার মধ্যে ২০ শতাংশ ছিল মুসলিম’-বলেন ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শহরে অবস্থিত ক্যাথলিক ইমিগ্রান্ট সেন্টার (যেটি কিনা মিশন পিস নামেও পরিচিত) এর প্রধান পাওলো পারিসে। পারিসে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে মূলত নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমানরা এসেছেন। ‘সম্প্রতি আমরা আফগানিস্তান থেকে আগত মানুষদেরও স্বাগত জানিয়েছি’-যোগ করেন তিনি।
অর্থনৈতিক সংকট ও সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ায় বিপুল সংখক এই অভিবাসন প্রত্যাশী ও শরণার্থীরা গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে ব্রাজিলকে ট্রানজিট দেশ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। পারিসে বলেন, ‘ভ্রমণ ভিসা নিয়ে তারা ব্রাজিলে আসে এবং এরপর তারা শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন।’
এর কয়েক মাস পর তারা হাইতি, ভেনেজুয়েলা ও অন্যান্য দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের মতো জনপ্রিয় রুটগুলো ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এ পথগুলোর প্রায় প্রতিটিই নানা ধরনের প্রতিকূলতা ও সংকটে ঠাসা।
গতবছরের জুলাইয়ে, মেক্সিকোতে করা ৭০ শতাংশ শরণার্থী আবেদন ছিল শুধুমাত্র সীমান্ত শহর ছিয়াপাসকে ঘিরে। মূলত ৪২ ধারার আইনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিস্কৃতদের বহনকারী দৈনিক ফ্লাইটগুলো এই শহরে অবতরণ করে।
৩৪ বছর বয়সী ঘানার নাগরিক আহমেদ উসমান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত সংলগ্ন শহর তিজুয়ানার মেক্সিকান সিটিতে বসবাস করছেন। তিনি ব্রাজিলে ১ বছর আট মাস অবস্থান করেছিলেন। ‘ক্রিকিউমাতে (ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহর) আমি একটি কারখানায় কাজ করতাম। এখান থেকে যা রোজগার করতাম তা থেকে বাসা ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ বাদে বাকি টাকা পরিবারের কাছে পাঠাতাম। আমার কাছে আর কোনো টাকা থাকতো না’- আরব নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন উসমান।
ক্রিকিউমাতে ক্ষুদ্র একটি মুসলিম কমিউিনিটি আছে। কিন্তু উসমান জানাচ্ছেন, তিনি তার নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের চেয়েও বেশি সহযোগিতা পাচ্ছেন খ্রিস্টানদের কাছ থেকে।
২০১৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পেরু, ইকুয়েডর, কলাম্বিয়া, পানামা, কোস্টা রিকা, নিকারাগুয়া ও গুয়াতেমালা রুট ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন। শেষপর্যন্ত এতগুলো দেশ পেরিয়ে তিনি মেক্সিকোতে পৌঁছান। ‘আমাদের টাকার অভাব ছিল। যাত্রাপথে অনেক মানুষকে আমরা অসুস্থ হতে দেখেছি। অনেককে মারা যেতে দেখেছি’-ক্লান্তি আর অবিশ্বাসে ভরা দৃষ্টি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন উসমান।
কোস্টা রিকায় উসমান আট মাস থেকেছেন। যেখানে তিনি সানহোসে শহরের মসজিদ ও ক্যাথলিক গির্জা থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন। এছাড়া ‘একজন মানুষ আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের বহুবেলা খাইয়েছেন। এমনকি তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমরা শুকোরের মাংস খাই না।’
২০১৭ সালে উসমান মেক্সিকোতে পৌঁছতে সক্ষম হন। তিজুয়ানায় তিনি কাজ খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং এখন পর্যন্ত সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা থেকেও নিজেকে বিরত রেখে চলেছেন।
উসমানের মতো প্রায় একইরকম গল্প আরো অসংখ্য মানুষের ক্ষেত্রে আছে, যারা কিনা মেক্সিকোতে আসার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মূলত মেক্সিকো ট্রানজিট দেশ ও আশ্রয় নেয়ার অন্যতম গন্তব্যে পরিণত হয়ে উঠছে।
২০১৪ সালে ২ হাজারে একশত মানুষ মেক্সিকোতে এসেছে এবং শরণার্থী মর্যাদার আবেদন করেছিল। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালে সেই আবেদনের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজারে।
‘এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মুসলিম কমিউনিটিগুলো অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতিযোগী অথবা সমস্যা হিসেবে দেখে। সহযোগিতা করার জন্য অনেকেরই সক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা সমস্যায় পড়তে পারে ভেবে এড়িয়ে যায়’-বলেন মরোক্কায় জন্ম নেয়া শেখ আবদেররহমান আগদাউ। তিনি এল সালভাদরে বসবাস করছেন। বতর্মানে তিনি অন্যান্য অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে সহযোগিতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমনও হয়েছে যে, আগদাউ উইঘুর, সিরিয়ান ও ইরাকি শরণার্থীদের সহযোগিতা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্য যাদের কাছে পর্যাপ্ত কাগজপত্র নেই, তাদেরকে এসব তৈরিতে সহায়তা করেছেন। আগদাউয়ে গুয়ান্তামো বে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া সাবেক এক বন্দিকেও শরণার্থীর মর্যাদা পেতে সহযোগিতা করেছেন।
‘একদিন চার শিশুসহ এক সিরিয়ান পরিবারকে এল সালভাদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখানে তাদের পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল। কাউকে না পেয়ে তারা হতবিহব্বল হয়ে পড়েছিল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আগদাউ তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে সিরিয়ায় ফিরে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
তার বরাতে জানা যায়, ইসলামিক সংগঠনগুলো অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য আরো বেশি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে এবং তুলনামূলক ধনী দেশগুলোতে যাওয়ার ব্যাপারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
‘কিন্তু অনেক দেশে মুসলমানরা নিজেদের বিদেশি বা বহিরাগত অনুভব করেন এবং অনেকেই মনে করেন তাদের রাজনীতিতে জড়ানো মোটেও ঠিক নয়’-বলেন তিনি।
আগদাউয়ের প্রত্যাশা অভিবাসন প্রত্যাশীদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক ইসলামিক দলগুলোর এবং অভিবাসন প্রত্যাশীদের সহায়তাকারী নাগরিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আরো জোরদার হোক।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে বেশিরভাগ মুসলিম অভিবাসী মানবিক সহায়তার জন্য ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্যাথলিক চার্চের ল্যাটিন আমেরিকার নির্বাহী সম্পাদক এলভি মনজান্ট বলেন ‘আমরা ল্যাটিন আমেরিকায় এত বেশি মুসলিম অভিবাসন প্রত্যাশীকে স্বাগত জানাতে পারি না, যতোটা আমাদের ইউরোপীয় অংশীদাররা ইউরোপে করতে পারে। এর ফলে উল্লেখযোগ্য অভিবাসন প্রত্যাশী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রের পাশ দিয়ে চলে যায়।’
মনজান্ট আরব নিউজকে আরো জানান, ক্যাথলিক অভিবাসী আশ্রয় কেন্দ্রগুলি ইসলামিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখার চেষ্টা করছে এবং মুসলিমদের তারা স্বাগত জানায়। এর মধ্যে অনেকেই মুসলিমদের খাবার সরবরাহের সময় হালাল-হারাম খাবারের দিকে সতর্ক থাকছেন এমনকি অনেকে মুসলিমদের নামাজের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
‘হয়তো কখনো কখনো কাজ করতে গিয়ে আমরা তাদের প্রতি অপ্রত্যাশিত ভুল করে ফেলতে পারি। এক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত স্থানগুলিতে তারা আরো ভালো অনুভব করতে পারে’-যোগ করেন মনজান্ট।