দেশের নাগরিকদের নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক সেবা প্রদান ও সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে সরকার কার্যত ২০১০ সাল থেকে সিটিজেন চার্টার (Citizen Charter) বা সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রেখেছে।
সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, ও প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ফরমেট অনুযায়ী তাদের সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে বাধ্য। মূলত: সেবার নাম ও ধরণ, প্রাপ্তির জন্য করণীয়, ফর্ম প্রাপ্তির স্থান, সেবা প্রাপ্তির মূল্য, সময়সীমা, বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি সিটিজেন চার্টারে উল্লেখ করা থাকে- যা দেখে ও অনুকরণ করে যেকোনো নাগরিক সেবা পেতে পারেন সহজেই; এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় অভিবাসন প্রত্যাশী, অভিবাসীর পরিবার ও বিদেশগামী কর্মীরাও।
শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান যেমন: প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET), জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় (DEMO), কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (TTC), প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (PKB), প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড (WEWB) – ইত্যাদিও নাগরিক সেবা প্রতিশ্রুতি বা সিটিজেন চার্টার অফিস প্রাঙ্গনে ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করে থাকে।
সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য সিটিজেন চার্টার কাঠামোতে কি ধরণের কাগজপত্রাদির প্রয়োজন বা সেবার আবেদনের ফর্ম এবং সেবা প্রাপ্তির সময়সীমা উল্ল্যেখ থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে সেবা না পেলে বা সেবা প্রদানকারী ব্যক্তির কর্ম অবহেলার প্রমাণ থাকলে সেবা গ্রহীতার জন্য রয়েছে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রাপ্তির বিষয়গুলো ও উল্লেখ করা থাকে সিটিজেন চার্টারে।
আরো পড়ুন: অভিবাসীদের কল্যাণ কি শুধু অভিবাসীদের অর্থেই সীমাবদ্ধ?
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে, কাগজ নির্ভর প্রক্রিয়া ছাড়াও সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অনলাইন বা ডিজিটাল সেবা প্রাপ্তির সুযোগ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের সিংহভাগ অভিবাসী কর্মী, কর্মীর পরিবার, বিদেশগামী কর্মী ও অভিবাসন প্রত্যাশীরা এসব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞাত নন।
এসব সেবার ভিতর রয়েছে: অনলাইনে ভিসা যাচাই, পাসপোর্টের জন্য আবেদন, অনুমোদিত ওভারসিস রিক্রূটিং এজেন্সীর তালিকা, অনলাইনে কর্মী নিবন্ধনের ব্যবস্থা, বিদেশে আটকে পড়া অভিবাসী কর্মীকে দেশে ফেরত আনয়ন বা অভিবাসী কর্মীদের প্রতারণা সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত সাইট (http://ovijog.bmet.gov.bd/ComplaineForm) ও মোবাইল এপ্লিকেশন (আমি প্রবাসী), অনলাইনে প্রবাসী কল্যাণ সেবা (যেমন: সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা, চিকিৎসা সহায়তা) প্রাপ্তির আবেদন (http://www.wewb.gov.bd/), অনলাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ (http://www.bkttcdhaka.gov.bd/index.php/index/allecourses) ইত্যাদি।
যদিও কিছু বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন প্রবণ এলাকা বা জেলা গুলোতে কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে অভিবাসী পরিবারগুলোকে সচেতন ও সহায়তা করে থাকে – কিন্তু সিটিজেন চার্টার ও সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সেবা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা ও এই বিষয়ে নাগরিকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুব একটা কাজ করা হয় না বললেই চলে । ফলে, অসম্পূর্ণ ও ভুল আবেদনের জন্য তাদের সেবা প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয় ও অনেক সময় যোগ্য হয়েও সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
আবার দেখা যায়, সেবা প্রাপ্তির মূল্য ও কাগজপত্রাদি প্রক্রিয়াকরণের জ্ঞানের ঘাটতির জন্য তারা এক শ্রেণীর দালালের শরণাপন্ন হন ও নির্ধারিত মূল্যের বা বিনামূল্যের সেবা তারা অনেক অর্থের ব্যয় করে নিচ্ছেন। ফলে তাদের প্রতি প্রতারণার সুযোগ ও থাকে অনেক।
অভিবাসন প্রত্যাশী কর্মীদের মূলত প্রয়োজন হয় পাসপোর্ট আবেদন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও রিক্রূটিং এজেন্সি বা বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সেবার বা তথ্যের। আবার বিদেশগামী কর্মীদের প্রয়োজন হয় প্রাক-অভিবাসন বা বহির্গমন প্রশিক্ষণ, অভিবাসন ঋণ, ভিসা যাচাই, বীমা ইত্যাদি সেবাসমূহ।
আরো পড়ুন: অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা
অন্যদিকে প্রবাসী কর্মীদের পরিবারের জন্য রয়েছে সরকারের নানান ধরণের কল্যাণ সেবা – যার তথ্য ও তাদের জানা উচিত। উক্ত তিন ধরণের জনগোষ্ঠীর সেবা প্রদানে রয়েছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর, যাদের রয়েছে নিজস্ব সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি বা সিটিজেন চার্টার। যদিও সব প্রতিষ্ঠানে সেগুলো প্রদর্শন যোগ্য স্থানে রাখা হয়েছে বা ওয়েবসাইটে দেয়া আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবে আমাদের অভিবাসন প্রত্যাশী ও বিদেশগামী কর্মীরা সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে না।
আবার দেখা যায়, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে, ত্রুটিপূর্ণ আবেদন, ডকুমেন্টস স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো সিটিজেন চার্টারে উল্লেখিত সময়সীমার ভিতর সেবা দিতে পারেন না। ফলে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অভিবাসন প্রত্যাশী ও বিদেশগামী কর্মীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং নির্ভরশীল হয়ে পড়েন স্থানীয় দালালদের ওপর।
এর জন্য আমাদের প্রয়োজন অভিবাসী পরিবার ও অভিবাসন প্রত্যাশী কর্মীদের সিটিজেন চার্টার ও সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, অনলাইন সেবা প্রাপ্তির উপরে সচেতন করা, ডিজিটাল শিক্ষা প্রদান করা, স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠ পর্যায়ে সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে অভিবাসী পরিবারগুলোকে সহায়তা করা। আশা করা যায়, অভিবাসী পরিবার ও শ্রম অভিবাসন প্রত্যাশীরা সচেতন হলেই সরকারি সেবা প্রাপ্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতার ক্ষেত্রও বিস্তৃত হবে।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী