অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে চাপ কমাবে টেকসই গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনা

0
4797

সজীব কুমার পান্ডে

রোজ রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষের ঢাকামুখী ঢল । কাকডাকা সকালে বিভিন্ন শহরতলীতে দেখা মেলে গ্রাম থেকে দলে দলে কাজের জন্য জমায়েত হওয়া মানুষের ভীড়। আরো চোখে পড়ে কিছু ভাসমান মানুষের দল শেষসম্বল হাতে পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে শহরতলীতে পাড়ি জমিয়েছেন খাবার যোগাড়ের আশায় ।

কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দীনতা দূর করতে এই মানুষগুলো যে প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকার আশায় শহরে আসছে তা নয় বরং এর পাশাপাশি রয়েছে ভালো থাকার প্রত্যাশা আর দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষার প্রয়াস।

বর্তমান সময়ে বিশ্ব এবং মানবজাতির অন্যতম একটি ভয়াবহ সমস্যা হল জলবায়ু পরিবর্তন। ভৌগোলিক বিচিত্রতা, উপকূলীয় অবস্থান, অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, দরিদ্রতা, প্রকৃতির উপর অধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ। ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স’ ২০২০ অনুযায়ী, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যে দশটি দেশ সর্বাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘটে জীবনহানি, নষ্ট হয় সম্পদ। থেমে যায় উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। দুর্যোগের শিকার হয়ে একটি শ্রেণি হারায় তাদের স্থানীয় কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে হারায় মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও। তাই স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়ে এইসব মানুষেরা জীবন-জীবিকার আশায় হচ্ছেন শহরমুখী। আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে ঘটে চলছে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৫ সালে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার ছিল প্রতি হাজারে ৯০ জন এবং এই সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এমনিতেই অতিরিক্ত জনসংখ্যা, জমির স্বল্পতা, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরক্ষরতাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ। তার উপর ক্রমবর্মান এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলেছে।

আমাদের দেশের ভূ-ভাগ মূলত নিম্ন সমভূমি অঞ্চল হওয়ায় প্রতিবছরই এখানে কম-বেশি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনে থাকে। সেই সাথে খরা, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, বন্যার কারণে প্রতিনিয়ত স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্মুখীন হতে হয় নানা প্রতিকূলতার। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামে বারবার ভিটেহারা মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলে। জীবনের তাগিদে, জীবনমান উন্নয়নের আশায় অনেকেই তাই দলে দলে ছুটছেন শহরতলীতে।

গ্রামে একটি কথা প্রায়শই শোনা যায়, বাড়ির বা এলাকার মানুষ অনেকই কাজের জন্য বিদেশ গেছে। বিদেশ। কথাটা শোনা মাত্রই চোখে ভেসে ওঠে দেশ ছেড়ে দূরের কোন দেশে যাওয়া। একটি নতুন সম্ভাবনা। অর্থ উপার্জন করে পরিবার, সমাজ, দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা। কিন্তু আসলে এই বিদেশ মানে দেশের বাইরে নয় বরং গ্রামীণ মানুষগুলোর সরল স্বীকারোক্তিতে দেশেই নিজের ভিটা ছেড়ে অন্য কোন স্থানে ভালো থাকার আশায় নিজেকে, নিজেদেরকে স্থানান্তর করাটাই বিদেশ যাওয়া। সেটি কখনো ঘটে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আবার কখনো হয় স্থায়ীভাবে।

একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, গ্রাম থেকে শহরমুখিতার এই স্রোতে মোটা দাগে দুই শ্রেণির মানুষ রয়েছেন। প্রথম শ্রেণিতে রয়েছেন- নিম্নবিত্ত, অভাবী শ্রেণি, যারা জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার তাগিদে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেন। দ্বিতীয় শ্রেণিটি হলো মধ্যবিত্ত পরিবার। যারা তাদের সঞ্চিত সম্বলটাকে পুঁজি করে ভালো উপার্জনের আশায়, পরিবারের অধিকতর উন্নতির জন্য শহরমুখী হন।

জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধাক্কাটা আসে এই প্রথম শ্রেণির মানুষগুলোর উপর। অর্থনৈতিক মানদণ্ডের তলানিতে অবস্থান করা এই অসুরক্ষিত শ্রেণিটি দুর্যোগকালে ভয়াবহতার কবলে পড়েন। বাস্তু হারিয়ে, দুমুঠো অন্নের সংস্থানে স্থানন্তরিত হতে বাধ্য হন তারা।

তবে, কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যই যে এর জন্য দায়ী তা নয়। গ্রামের অনুন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা, দুর্যোগ সহনীয় টেকসই অবকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অপর্যাপ্ততার কারণেও শহরে স্থানান্তরের এই প্রচেষ্টা বিরাজমান। ফলে চাপ বেড়েছে শহরতলীতে। আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি হলেও মৌলিক সেবা ব্যহত হচ্ছে।

একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় যেখানে খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, নদীভাঙন রয়েছে সেখানে জীবন বা উন্নয়ন কাঠামো মনস্তাতিকভাবে একই রয়ে গেছে। গ্রামীন পরিকল্পনায় সর্বদা প্রতীয়মান হয় এক ধরণের সাদামাঠা গড়পত্তা উন্নয়নের রূপরেখা।

এরই অংশ হিসেবে আমরা দেখতে পাই নদীভাঙন এলাকায় বালির বাঁধ, খরা প্রবণ এলাকায় সুপেয় পানির আশ্বাস আর বন্যাপ্রবণ স্থানে ত্রাণের প্যাকেটের আয়োজন। স্থায়ীভাবে সমন্বিত উন্নয়ন প্রচেষ্টা অধরাই থেকে যায় । গ্রামীন স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জীবিকার উন্নয়ন না ঘটিয়ে বারবার ত্রাণের প্যাকেট নিয়ে ছুটে চলার এই সংস্কৃতি গ্রামীণ ও শহুরে অবকাঠামোর পরিকল্পনায় তৈরি করছে বিস্তর বৈষম্য।

এককেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা এভাবেই বাধাগ্রস্ত করছে টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায়। যার স্বাভাবিক পরিণতিতেই জীবন জীবিকার জন্য মানুষ হয়ে পড়ছে শহরকেন্দ্রিক। একটি নির্দিষ্ট স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ঘনবসতি। অসুরক্ষিত সুবিধাবঞ্চিত এই সব মানুষের একটি বড় অংশ ছড়িয়ে পড়েছে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। প্রথাগত জীবিকায় এসেছে ভিন্নতা। হয়তো পাওয়া যাবে অনেক জীবিকার বিলুপ্তির ইতিহাস। টিকে থাকার এই প্রতিযোগিতায় পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আমাদের চিরায়িত সংস্কৃতিতেও।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সবসময়ই শিখেছে মানুষ। প্রয়োজন হলো মৌলিকত্বকে ধরে রাখা। বিদেশী ফর্মুলা নয় দরকার স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন। কথিত ধারণাকে আঁকড়ে না ধরে সমবন্টন ও সমঅধিকারের নীতিতে কাজ করা।

এককেন্দ্রিক সেবাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রয়োজন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যেগ গ্রহণ করা। দক্ষ মানবগোষ্ঠী তৈরি করা। প্রয়োজন গ্রাম ও শহরের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কখনোই বন্ধ হবার নয়, কিন্তু পরিকল্পিত অভিবাসন হলে যেমন সচল হবে অর্থনীতির চাকা তেমনি দূর হবে বৈষম্য।

সেই সঙ্গে প্রয়োজন কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে প্রকৃতিকে তার নিজ গতিতে চলতে দেওয়া । তবেই রক্ষা পাবে প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষ। তাই বিশ্বকবির সুরে আমাদেরও আজ এই প্রার্থনা- ‘দাও ফিরে সেই অরণ্য লও এ নগর। দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান, সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান।’

লেখক: উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here