অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও অভিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন

0
1741

আমিনুল হক তুষার

কর্মক্ষেত্র কিংবা পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু সামাজিক, ধর্মীয় ও মানসিক সংকীর্ণতার জন্য সেই সমতা বিধান অনেকক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী এখনও প্রতীয়মান হচ্ছে এই চিত্র। পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করে বিদেশে কর্মরত নারী অভিবাসী কর্মীরাও এর ব্যতিক্রম নন।

ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের মোট সংখ্যায় নারীরা প্রায় অর্ধেক, আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, নিজ দেশ বা বিদেশে সব ক্ষেত্রেই নারীরা বৈষম্যের শিকার হন, কিংবা হন শোষণ ও নিপীড়ণের শিকার। কখনও কখনও সমতা অর্জন তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই শোনায় । যদিও তারা পুরুষদের মত দীর্ঘদিন যাবৎ নিজ পরিবার ছেড়ে অর্থ উপার্জনের জন্য শ্রম দিচ্ছেন, কিন্তু মজুরি প্রাপ্তিতে বা উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রাপ্তিতে ভীষণভাবে শিকার হচ্ছেন বৈষম্যের।

পুরুষ অভিবাসী কর্মীর চেয়ে প্রায় ২০% কম পারিশ্রমিক পান নারীরা

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা স্থিতিশীল ও স্থায়ী করার জন্য অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে বুঝায়: ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক চাহিদা যেমন: লেনদেন, অর্থ উত্তোলন, সঞ্চয়, ঋণ এবং বীমা ইত্যাদি সেবা সহজীকরণ ও স্থায়িত্বকরণ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের ধারা স্থিতিশীল রাখতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও রক্ষণশীল চিন্তাধারা অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

নারী প্রবাসী কর্মীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স নারীদেরকে সাবলম্বীকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে । রেমিট্যান্সের কারণে নারীরা যেমন একদিকে তাদের পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেকে এবং তাদের পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত ও দরিদ্রতার ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারছে; তেমনি পেশাগত অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে তাদের প্রতি শোষণ দূরীকরনের মাধ্যমে নিজেদেরকে বহুমুখী উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সংযুক্ত করতে ও সক্ষম হচ্ছে।

জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে নারীরা যদিও পুরুষ অভিবাসী কর্মীর চেয়ে প্রায় ২০% কম পারিশ্রমিক পান, কিন্তু তারা পুরুষের চেয়ে তাদের পারিশ্রমিকের বেশি অংশই দেশে পাঠিয়ে দেন।

নারীরা পুরুষদের চেয়ে ২৫% বেশি খরচে রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে থাকেন

এর কারণ হিসেবে দেখা যায়-

ডিজিটাল লেনদেন বা আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল সম্পর্কে ধারণা বা এর ব্যবহারের দক্ষতা না থাকা । রেমিট্যান্স ট্রান্সফার সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মক্ষেত্র হতে দূরে হওয়ায় তারা বিভিন্ন মাধ্যমে বেশি খরচে টাকা পাঠাতে বাধ্য হন।সঠিক আর্থিক শিক্ষা না থাকায় বা সেবা সহজলভ্য না হওয়াতে অনেক নারী কর্মীই হতাশ হন, এবং অধিকতর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হতে পরবর্তীতে বিরত থাকেন।

ফলস্বরূপ ব্যাহত হয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমতা অর্জন ও দেশের অর্থনৈতিক সামষ্টিক উন্নতি।

অনেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতাকে সমতার মূলভিত্তি হিসেবে গণ্য করে থাকেন। নারীর যদি রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি আর্থিক সেবা ও পরিষেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়, তবেই দেখা যাবে তারা নিজেদেরকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে সংসারের আয় বৃদ্ধিতে সমান অবদান রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে বলাই যেতে পারে যে, রেমিট্যান্স গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা প্রবাসী পরিবারের নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের এক অনন্য উপায়।

জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারীরা প্রত্যক্ষভাবে সংসারের কল্যাণে ও সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের উজ্জ্বল ভবিৎষত গঠনে অবদান রাখতে পারেন। তবে তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিশ্চয়তা দিতে হবে সম-মজুরির, দ্বিতীয়ত সমান কর্মের অধিকার ও সুযোগ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণ সহজীকরণ ও ব্যয় হ্রাসকরণ।

কিন্তু এর জন্য প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রয়োজন নারী অভিবাসী কর্মী ও অভিবাসী কর্মীর স্ত্রীদের বা মায়েদের জন্য আর্থিক শিক্ষা নিশ্চিত করা । যেন তারা জানেন যে কোথা থেকে কি কি আর্থিক সেবা পাবেন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে, নারীরা কিভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুবিধা নিতে পারেন? হ্যা, বিভিন্ন উপায়েই পারেন-

  • এটি হতে পারে তাদের জন্য সামাজিক বীমা সহজলভ্যকরণের মাধ্যমে।
  • হতে পারে সহজশর্তে ঋণ প্রাপ্তির বা বিতরণের মাধ্যমে।
  • কারিগরি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ।
  • আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা সহজীকরণ ও নারীবান্ধব করার মাধ্যমে।

মূলত: জেন্ডার সমতা অর্জন এবং কিশোরী ও নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা। তাছাড়া জেন্ডার সমতা অর্জন এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নারীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য আসলে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সেবা প্রদান। প্রয়োজনে তৃণমূল ও গন্তব্য দেশ পর্যায়ে কাজ করতে হবে, প্রণয়ন করতে হবে নীতিমালা ও কৌশলগত পরিকল্পনা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটু সচেষ্ট হলেই অভিবাসী নারী ও অভিবাসী কর্মীর স্ত্রী বা তার পরিবারের নারী সদস্যদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে যুক্ত করা সম্ভব, যার দ্বারা নিশ্চিত করা যাবে রেমিট্যান্সের সর্বোচ্চ ও সঠিক বিনিয়োগ।

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here