ফরহাদ খান আফগানিস্তানে শাহরুখ খান হিসেবে জনপ্রিয় তারকা খ্যাতি লাভ করার পরও শরণার্থী জীবনে আজ উপায় না পেয়ে তাকে দর্জির কাজ করতে হচ্ছে
ভক্তদের অনেকেই এই কথাটি এক বাক্যে স্বীকার করে নেয় যে, ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের লাখ লাখ ভক্ত আছে। বহু বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের কাছে বলিউড ছবির অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে কিং খান অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বও বটে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানেও তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
আফগানিস্তানে শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে যে, দেশটির একজন অভিনেতা বেশিরভাগ সময়ই তার মতো করে, তাকে হুবুহু অনুকরণ করে অভিনয় করেন। আর এর সুবাদেই পুরো দেশজুড়ে ফরহাদ খান নামের এই অভিনেতা অর্জন করেছেন দারুণ সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা। যদিও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বর্তমানে এই অভিনেতার পরিচয় শুধুই একজন শরণার্থী ও উদ্বাস্তু।
মার্কিন বাহিনিকে হটিয়ে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের পর জীবন বাঁচাতে ফরহাদ খান পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাকিস্তানের করাচিতে। আর সেখানে বসেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন ভিন্নরকম এক সংগ্রাম। অথচ একটা সময় তিনি প্রতিটি মুহূর্ত ব্যস্ত সময় পার করতেন ক্যামেরার সামনে, তার অভিনীত ছবি আফগানিস্তানে সুপার ডুপার ব্যবসা করতো, তার প্রতি মুহূর্মুহূ তালি আর উল্লাস ধেয়ে আসতো দর্শক সারি থেকে।
পুরোনো দিনগুলোর স্বর্ণালী স্মৃতিগুলো বিরতিহীনভাবে তাড়িয়ে বেড়ায় ২৯ বছর বয়সী ফরহাদ খানকে। এ অভিনেতা একটিবারের জন্যও ভুলতে পারেন না তার ফেলে আসা দিনগুলোকে।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে ফরহাদ খান তার অনুভূতি ও বিদ্যমান পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করেছেন। আফগান এই চলচ্চিত্র তারকা পাকিস্তানের করাচিতে আফগান বস্তিতে তার প্রতিবেশীর বাড়ির ড্রইংরুমে বসেছিলেন। কথা বলার সময় তার পরণে ছিলো কালো ব্লেজারের সঙ্গে মানানসই ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক। ড্রইংরুমের দেয়ালগুলি হালকা বেগুনি রঙে আচ্ছাদিত ছিল। দেয়ালে বন্দি হালকা বেগুনি রঙ আর ফরহাদ খানের ফ্যাকাশে কণ্ঠ তখন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আচমকা ঝড় নেমে আসার আগে তিনি কীভাবে অভিনয়ের জগতের প্রবেশ করেছিলেন, নিজের জীবনকে সাজানোর প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন এসব কথাই তিনি ব্যক্ত করছিলেন।

আফগানিস্তানের মানুষের কাছে ফরহাদ খান বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান হিসেবে বেশি পরিচিত। কারণ ফরহাদ খান অভিনয় করার সময় শাহরুখ খানকে হুবুহু অনুকরণ করতেন এবং দর্শকও তার অভিনয়কে প্রাণভরে উপভোগ করতেন। এভাবে শাহরুখ খানকে অনুকরণ করে অভিনয় করতে করতে একটা সময় তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় মুখ।
অবশ্য তার এই সফল পথচলা হঠাৎই থমকে যায় গত বছরের অগাস্টে, যখন তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়। জীবন বাঁচানোর উপায় না পেয়ে আফগানিস্তানের জনপ্রিয় এই তারকা পালিয়ে যেতে বাধ্য পাকিস্তানে। বর্তমানে পাকিস্তানের করাচির একটি বাড়িতে তিনি শরণার্থী পরিচয়ে বসবাস করছেন। আর এখানে বসেই এই তরুণ আফগান চলচ্চিত্র তারকা ফ্ল্যাশব্যাকে রোমন্থন করেন, কীভাবে তিনি পুরো আফগানিস্তানের মানুষের হৃদয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন।
ফরহাদ খান বলছিলেন, ‘আমি শাহরুখ খানকে নকল করে এবং আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যহীন ক্লিপ তৈরি করে শখের বশে অভিনয় শুরু করেছিলাম।’ চোখের পলকে কীভাবে ফরহাদের জীবন এলোমেলা হয়ে গিয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি জানান, যেদিন তালেবানরা কাবুল দখল করে, সেদিন তিনি একটি বিগ বাজেটের ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। এ সময় অতর্কিত হামলা শুরু হলে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে কোনোভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন তিনি।
আফগানিস্তানের শাহরুখ খান হিসেবে পরিচিত ফরহাদ খান ১৯৯০ সালে আফগান শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানের করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। শাহরুখ খান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘দার’ (ভয়) দেখার পর তিনি কিশোর বয়সে অভিনয়ের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি বলিউড রাজা শাহরুখ খানের অভিনয়ের প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত তার মতো করে অভিনয়ের চেষ্টা করতে থাকেন। নকল করতে করতেই একটা সময় স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি শাহরুখ খানের মতোই নামজাদা অভিনেতা হবেন।
তবে ফরহাদ খানের এ যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৫ সালে অর্থনৈতিক অবস্থাকে মজবুত করতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলেন তিনি। শুরুতে সেখানে তিনি দর্জির কাজ করতেন। যদিও তার মনের ভেতর ছিল অভিনয়ের প্রতি সূক্ষ্ম টান। নিজের এ স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি শহরের তাকসিম স্কয়ারের কোলাহলপূর্ণ হোটেলগুলিতে শো করা শুরু করেন।
ফরহাদ খান শাহরুখ খানের ছদ্মবেশ ধারণ করে তার দর্শকদের বিনোদিত করেছিলেন। আর ঠিক তখনই তিনি একজন তুর্কি প্রযোজকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ‘আমার বন্ধু ওকতের সঙ্গে তুরস্কের ড্রামা ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু প্রজেক্টে কাজ করেছিলাম। তুরস্কে কাজ করার মধ্য দিয়ে আমি আরো বেশি পেশাদারিত্ব অর্জন করি। এরপর আমি ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে চলে আসি। এখানে আমি দুটি চলচ্চিত্রে কাজ করি’-ফরহাদ যোগ করেন।
দেশে ফেরার পর ফরহাদ খানের দরজায় সাফল্য কড়া নাড়ে। ২০২০ সালে তিনি ‘দেহশতগার্ড’ নামের একটি বিগ বাজেটের ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যদিও প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি কাজ ২০২১ সালের গ্রীস্মের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৫ অগাস্ট কাবুল তালেবানদের দখলে চলে যাবার কারণে ছবিটির কাজ বন্ধ করতে হয়েছিল।
পাকিস্তানে পালিয়ে আসা
‘কাবুলে যেদিন তালেবানরা প্রবেশ করে সেদিন আমি শুটিং করছিলাম। পুরো কাবুল বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল।’
‘পুরো ইউনিট ক্যামেরা, লাইটসহ পুরো সেট ফেলে রেখে আমরা সবাই চলে এসেছিলাম। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমার জীবন বদলে গেল। প্রথমে কান্দাহার গিয়েছিলাম, এরপর চমন সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে আসি এবং এরপর করাচি পৌঁছাই’-স্মৃতিচারণ করেন ফরহাদ।
কথাগুলো বলতে বলতে ফরহাদের কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসছিল; বলতে থাকেন, তিনি কেবল ওই দিনটিকে তার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চান। কারণ সেই দিনটি তাকে তার স্বপ্নের চূড়া থেকে মাটিতে নামিয়ে আনতে বাধ্য করেছিল। তিনি পরিণত হয়েছিলেন যেন দেশ হারা এক মানুষে।
শুধু ফরহাদ খানই নন…
একই দিন একইভাবে ফরহাদের মতো মিনা ওয়াফা নামের একজন সঙ্গীত শিল্পী কাবুল ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে । এখন মিনার বয়স ২৫ বছর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সঙ্গীত জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি পশতু ও ফার্সি ভাষায় গান করতেন। ওয়াফা তার দেশে গান করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
১৫ অগাস্ট কোনো রকম কাগজপত্র ছাড়া একাকি নারী হিসেবে পাকিস্তানে প্রবেশ করার সময় ওয়াফা উদ্বিগ্ন ও ভয়ার্ত হয়ে পরেছিলেন।
‘পুরো যাত্রাপথে মনে হচ্ছিলো আমি মারা গেছি। বিমূঢ় ও স্তব্ধ হয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম তালেবানরা চিলে ফেললে আমার কি হবে? আমি যখন চমন সীমান্তে পৌঁছলাম তখন পাকিস্তানে ঢুকতে আমাকে প্রায় ৬০০ ডলার দিতে হয়েছিল।’
‘আফগানিস্তানে আমার এমন একটি অসাধারণ জীবন ও ক্যারিয়ার ছিল। আমি শোতে পারফর্ম করতে ভারত ও দুবাই ভ্রমণ করেছি। আর্থিকভাবে আমার ভালো অবস্থান ছিল। এখন আমার কিছু নেই। এমনকি পাকিস্তানে একটি আফগান কার্ড পেতে আমাকে প্রায় ৩০০ ডলার দিতে বলা হচ্ছে’-বলেন মিনা ওয়াফা।

গত ২০ বছরে আফগানিস্তানের বিনোদন শিল্প মার্কিন নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে সমৃদ্ধ হয়েছিল। এর ফলে ফরহাদ খান ও মিনা ওয়াফার মতো প্রতিভাবানদের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু মার্কিন বাহিনির ‘পালিয়ে’ যাওয়া ও তালেবানদের ক্ষমতা দখলের কারণে এ পরিস্থিতি রাতারাতি উল্টে গেছে।
ফরহাদ খান বলছিলেন বিনোদন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা আফগানিস্তানে আটকে আছে। এমনকি সালিম শাহীনের মতো আফগানিস্তানের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতারাও তালেবানদের শাসনের অধীনের থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘সালিম শাহীনকে সারা বিশ্ব চেনে, তার মতো মানুষও যদি অসহায় বোধ করে, ভাবুন পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির লোকজন কাবুলে আটকে আছে। তারা সেখানে মোটেও কাজ করতে পারছে না’-বলেন ফরহাদ।
তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর ৩ লাখ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এর মধ্যে লাখ খানেক বৈধ ভিসায় পাকিস্তানে প্রবেশ করেছিল। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্যমতে, পাকিস্তানে নিবন্ধিত আফগান শরণার্থীর সংখ্যা ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন। যাদের বেশিরভাগই ১৯৭০ সাল থেকে দেশটিতে বসবাস করছে।
শরণার্থীদের জন্য পাকিস্তানে সুযোগ কতটুকু?
উদ্বাস্তু হওয়ার কারণে পাকিস্তানের বিনোদন শিল্পে ফরহাদ খান ও মিনা ওয়াফার পক্ষে নতুন করে জীবন শুরু করাটা বিরাট চ্যালেঞ্জের। ‘আমি কিছু করছি না, আামি এখানে কাজও খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ আমার কোনো পরিচয়পত্র নেই’-অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে চলেন মিনা ওয়াফা।
এ প্রসঙ্গে করাচির ন্যাশনাল একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জুনায়েদ জুবেরির মতামত হলো : পাকিস্তানে উদ্বাস্তু পটভূমি থেকে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘তারা যে ধরনের জীবন কাটিয়েছে, সেটাকে তারা তাদের শিল্পের মাধ্যমে কীভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ।’
অবাক করার বিষয় হলো, ফরহাদ খান আফগানিস্তানে শাহরুখ খান হিসেবে জনপ্রিয় তারকা খ্যাতি লাভ করার পরও শরণার্থী জীবনে আজ উপায় না পেয়ে তাকে দর্জির কাজ করতে হচ্ছে। ‘আমি সেখানে (আফগানিস্তানে) প্রচুর অর্থ রোজগার করতে পারতাম। কিন্তু এখানে খুব কমই কিছু করতে পারি। আমি একজন শিল্পী এবং শিল্পের কোনো সীমানা নেই। তাই আশা করছি শিগগিরই আমি পাকিস্তানে কাজ করতে পারবো’-ফরহাদ খান।
লেখক: হাজিরা মারিয়াম। তিনি স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত । হাজিরা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মডার্ন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।