শনিবার, 20 এপ্রিল, 2024

প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিক অভিবাসী বাজেট

বিশ্বে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভিতর ঈর্ষণীয়। মূলত: জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি -বাণিজ্য সম্প্রসারণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভূক্তির দিকে ধাবমান।

সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুযায়ী জিডিপি রাঙ্কিং-এ বাংলাদেশ বিশ্বে ৪২তম, যার জিডিপি উন্নয়ন সূচক ছিল ৫% (২০২১)। বাংলাদেশে শ্রমমূল্যে জিডিপিতে অবদান ৫০.১১%, যেখানে কৃষিতে রয়েছে ১৪.২৩% ও শিল্পে রয়েছে ৩৫.৬৬%। যদিও কিছু পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪.২% জনগোষ্ঠী আজও বেকার ও দেশে কর্মসংস্থান হার মাত্র ৫৫.৮%। যদিও বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠী বিদেশে কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়াতে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে খুব একটা পড়েনি।

বাজেট বিশ্লেষণ

আমরা যদি বিগত অর্থ বছরের (২০২১-২২) অনুমিত জিডিপি দেখি, যার আকার ছিল ৩৪ লক্ষ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তাহলে ধারণা করতে পারি, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা। আমাদের ২০২১-২২ সালের জাতীয় বাজেট ও ছিল উক্ত জিডিপির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার আকার ছিল ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি  টাকা (প্রস্তাবিত বাজেট)।

জাতীয় বাজেটে যদিও প্রাধান্য পেয়েছিলো বৈদেশিক ঋণ/দেনা পরিশোধ, কৃষি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। কিন্তু যেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের প্রেরণকৃত রেমিট্যান্স মোট জিডিপির ৬.৬২% (প্রায় ২ লক্ষ ১০ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছর)- অংশে অবদান রেখেছিলো-তাদের জন্য তথাপি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল খুবই নগণ্য (মাত্র ০.১১%)।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত ও দেশকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশির কল্যাণ, সুরক্ষা, ও দক্ষ কর্মী গঠনের জন্য ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’, যা শুধু বিদেশে দক্ষ কর্মীর কর্মসংস্থানই করেনি, বরং বৈধ পথে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতেও সহায়তা করে আসছে।

যদিও প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘ওয়েজ আর্নার্স  ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ রয়েছে- যা পরিচালিত হয় অভিবাসীদের হতে প্রাপ্ত কল্যাণ ফি হতে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাবরই কম রয়ে গিয়েছে।

আমরা যদি  বিগত পাঁচ বছরের (২০১৬-২০২১) বাজেট বিশ্লেষণ করি, তাহলে সহজেই  বুঝতে পারবো এই খাত কতটুকু অবহেলিত: ২০১৬-১৭ (০.১৬%), ২০১৭-১৮ (০.১৭%), ২০১৮-১৯ (০.১৮%), ২০১৯-২০ (০.১১%) ও ২০২০-২১ (০.১১%) ।

আমাদের জিডিপি, জাতীয় বাজেট কিংবা অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের আকার ও পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণরূপে বিগত ১২ বছরে বাড়লেও, সেই অর্থে বাড়েনি মন্ত্রণালয়ের খাত ভিত্তিক বাজেট। যতটুকুও বেড়েছে -তাও বরাদ্দ ছিল অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য; কোনো সামাজিক সুরক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রান্তিক পর্যায়ে সেবার মান বৃদ্ধি, বিদেশ ফেরতদের রিইন্টিগ্রেশন (পুনরেকত্রীকরণ), কিংবা বৈধ অভিবাসনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ বা প্রস্তাব করা হয়নি বললেই চলে।

যদিও কিছু কিছু প্রকল্প চলছে বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে (যেমন: এপ্লিকেশন অফ মাইগ্রেশন পলিসি ফর ডিসেন্ট ওয়ার্ক ফর মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স, আইএলও- এসডিসির অর্থায়নে), কিংবা কল্যাণ বোর্ডের তহবিলের সাহায্যে। কিন্তু সরাসরি সরকারি অর্থায়নে অবকাঠামোগত (যেমন: ঢাকা কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশন স্থাপন, ৪০টি উপজেলায় ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামে একটি মেরিন টেকনোলজি স্থাপন, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ দপ্তরসমূহের সংস্কার, এবং ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ইত্যাদি) উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি।

যে সকল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন:

১. বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে: অবশ্যই সরকারি ও বেসরকারি (যেমন: রিত্রুটিং এজেন্সি, বহুজাতিক ও দেশীয় কোম্পানি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমন্বয়ে) উদ্যোগে ও অর্থায়নে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তথ্য কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন ও নিয়মিত অভিবাসনের/ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য সেবা প্রদান, সর্বজন উপযোগী তথ্যবহুল উপকরণ বিতরণ, সাপ্তাহিক/ মাসিক প্রশিক্ষণ/ওরিয়েন্টেশন/ব্রিফিং প্রদান ও চাকুরী মেলার আয়োজন। এর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে জেলা কর্মসংস্থান/ইউনিয়ন বা উপজেলা অফিসের আধুনিকায়ন ও মুক্তপাঠে প্রশিক্ষণ উপকরণ সংযোজন করার জন্য।

২. অভিবাসীর দক্ষতা বৃদ্ধি, সুরক্ষা ও কল্যাণ: এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সম্ভাব্য অভিবাসী শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদান, সরকারি বিশেষ বৃত্তিতে নূন্যতম ৩ মাসের ট্রেড ভিত্তিক কর্ম অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা (এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সমন্বয়ে কাজ করতে হবে)/কর্মসংস্থান ও স্কিল টেস্ট ভিত্তিক বৈদেশিক নিয়োগ নিশ্চিত করা (যেখান থেকে নিয়োগকর্তা/এজেন্সি দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মীদের নির্বাচন করবেন)। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রকল্প ছাড়াও – বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশন ও লেবার উইংসমূহে অভিবাসীদের আইনি, মেডিকেল সহায়তা, দুর্যোগকালীন সহায়তা, ও ওয়ার্ক প্লেস ভিসিট ও মনিটরিংয়ে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ রাখা ও সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ প্রদান বিশেষভাবে প্রয়োজন।

রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিতকল্পে সরকারি ও লাভজনক বিশেষ প্রকল্প শেয়ার (প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শেয়ারসহ) অভিবাসীদের নিকট বিক্রি ও লভ্যাংশ প্রদান, প্রতারণা কেস ও ক্ষতিগ্রস্থ অভিবাসীদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা আদালত স্থাপন- ইত্যাদিতে বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।

৩. নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরণ: অভিজ্ঞ অভিবাসী কর্মীদের (যাদের অভিবাসনের/বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মেয়াদ নূন্যতম ১৫ বছর) নিরাপদে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা প্রদান (যেন শুন্যস্থানে বাংলাদেশী যুবদের  কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়), সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরণের জন্য ব্যক্তি ও পরিবারের কাউন্সেলিং প্রদান, বিশেষ বিবেচনায় বিদেশ ফেরত কর্মীদের পেনশন প্রদান, রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ ও খাত নির্ধারণ, দেশে বিকল্প কর্মসংস্থান – ইত্যাদির জন্য বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন ও বরাদ্দ এবং জেলা পর্যায়ে অভিবাসী কেন্দ্র স্থাপন ও সেবা প্রদান আজ অত্যাবশকীয়। এজন্য জেলা পর্যায়ে ও ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ডাটাবেস তৈরী করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্সের সুফল ভোগ করতে আমাদের আসলে অভিবাসনের প্রতিটি ধাপে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। শুধু ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নের উপরে নির্ভর না করে আমাদের উচিত এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অধিকার নিশ্চিত করা ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরী করা।

এর জন্য প্রয়োজন দাতা গোষ্ঠীর ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি, রাজস্ব খাত হতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা – যেন অভিবাসীরা নিশ্চিন্তে দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্সের বিনিয়োগ করতে পারে ও নাগরিক হিসেবে নিজেকে সার্থক মনে করে।

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
97SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা