দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষেরা কীভাবে অভিবাসিত হয়েছিল-বিশেষত এ প্রসঙ্গের আদ্যপান্ত খুঁজে বেড়ানোতেই প্রধান আগ্রহ চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও শিক্ষক বিবেক বল্ড-এর। ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে এ চলচ্চিত্র নির্মাতা এমন একজন অভিনেতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যার বাবা আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন। অভিনেতা আলাদিন উল্লাহর এই প্রথম দেখা এবং তার বাবার সম্পর্কে কথপোকথনই জনাব বল্ডকে একটি মোটা গ্রন্থ লিখতে ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করেছিল।
১৯১৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন নিষিদ্ধ করেছিল এবং আরো আগে ১৮৮২ সালের চীনা বর্জন আইন এশিয়া থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগমনকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিল
বল্ডকে অভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা আলাদিন উল্লাহ জানিয়েছিলেন: তার বাবা হাবিব উল্লাহ আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে ১৯২০ এর দশকে তিনি নিউইয়র্কে এসেছিলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের হাত থেকে বাঁচতে তিনি একটি ব্রিটিশ স্টিমশিপ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শুধু তিনি নন, এই স্টিমশিপে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেরও প্রচুরসংখ্যক পুরুষ কাজ করতেন।
‘আমার কাছে ঐতিহাসিক প্রশ্নগুলির একটি সম্পূর্ণ সিরিজ ছিলো, এর মধ্য আমি ভেবেছিলাম যে, তার বাবার গল্প উত্থাপিত হয়েছে’-বল্ড স্মরণ করেন। ‘তার বাবা কি দক্ষিণ এশীয়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় মুসলমানদের একজন, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর অভিবাসনের অংশ ছিলেন, কিন্তু ইতিহাসে তা নথিভূক্ত করা হয়নি?’ গবেষণার শুরুতে এই প্রশ্নটি বল্ডকে অনেক বেশি ভাবিয়েছিল।
উল্লাহ এবং বল্ডের এই ইতিহাসের অন্বেষণ হলো ‘বেঙ্গলি হারলেম অ্যান্ড দ্য লস্ট হিস্টোরিজ অব সাউথ এশিয়ান আমেরিকা’ এর বিষয়বস্তু। এটি একাধারে একটি বই, ওয়েব প্রকল্প এবং তথ্যচিত্র। এসব কিছু তৈরী করতে ২০১৯ সালের শুরুতে এশিয়ান আমেরিকান মিডিয়া কেন্দ্র বল্ড অনুদান পেয়েছিলেন।
বল্ডের ১৯৯৪ সালের প্রামাণ্যচিত্র ‘ট্যাক্সি-ওয়ালা/অটো-বায়োগ্রাফি’ নিউইয়র্কের দক্ষিণ এশীয় শ্রমিকদের জীবনচিত্র তুলে ধরে। তিনি হাবিব উল্লাহর গল্পের প্রতিও সমানভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কারণ এটি কোনো নাটকীয় বিষয় ছিল না, বরং এই কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, অভিবাসিত এই মানুষটির অভিবাসিত জীবনের প্রথম দিককার সময়টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র এশিয়ান বিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে তিনি কীভাবে ওই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিলেন কিংবা মানিয়ে কোন কোন অনুষঙ্গ গুরুতরভাবে প্রভাব রেখেছিল, তা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বল্ড।
১৯১৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন নিষিদ্ধ করেছিল এবং আরো আগে ১৮৮২ সালের চীনা বর্জন আইন এশিয়া থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগমনকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিল।
‘সুতরাং আমার কাছে যা দাঁড়িয়েছিল তাহলো: ১৯১৭ সালে সত্যিই কঠোর অভিবাসন বিরোধী আইন পাশ হওয়ার পর তার বাবা এখানে এসেছিলেন এবং তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বর্জন নিয়ে হুলস্থুল সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন।
কিন্তু যখন বল্ড এবং আলাদিন উল্লাহ যখন হাবিব উল্লাহ ও তার প্রজন্মের অন্যান্য দক্ষিণ এশিয় অভিবাসীদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করার কথা বলতে শুরু করেন, তখন বল্ড অনুভব করেন, এখানে ঐতিহাসিক বিবরণ অনুপস্থিত। সেই উত্তরগুলো খুঁজতে গিয়ে তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
‘‘অনেক বছর ধরে আমি এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে মনোনিবেশ করেছি যে, ‘আলাদিনের বাবা কি বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ ছিল?’ বল্ড ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপনা করছেন। বল্ড এই প্রশ্নে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তার ২০১৫ সালের বই ‘বেঙ্গল হারলেম অ্যাট লস্ট হিস্টোরিজ অব সাউথ এশিয়ান আমেরিকা’ আকার নিতে শুরু করে। বল্ড বলেছিলেন যে, এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আলাদিন উল্লাহর বাবা জাহাজে মুসলিম ও বাঙালি শ্রমিকদের একটি-স্রোতধারার অংশ ছিলেন।
বাঙালি পুরুষরা-প্রাথমিকভাবে যারা এখনকার বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ১৯১০ এবং ১৯২০ এর দশকে ব্রিটিশ কোম্পানির জাহাজে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। সেই সময়ে নাবিক হিসাবে কাজ করা ছিল একাধারে অমানবিক এবং বিপজ্জনক। বল্ড এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘তারা কয়লা ভেঙে চুল্লিতে ঢেলে দিত।’ ‘তারা ঘন্টার পর ঘন্টা স্টিমশিপের ভেতর জ্বলন্ত চুল্লির পেটের মধ্যে থাকতো, যেখানে তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির বেশি থাকতো।’
বল্ডের গবেষণা অনুসারে, জাহাজে অনেক কর্মী ছিল, যাদের বয়স ছিল খুব অল্প-১৪ বা ১৫ বছরের মধ্যে। অমানবিক এই অবস্থা তাদের অনেককে যখনই সম্ভব জাহাজে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করতো, এই উদ্দেশ্যে যে, নিউ ইয়র্কে পৌঁছাতে পারলে জীবনের একটা মোড় ঘুরে যাবে। বল্ডের অনুমান, ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে ৭০০ থেকে ১ হাজার দক্ষিণ এশিয় জাহাজ শ্রমিক যুক্তরাষ্ট্রে বসত গড়েছিল।
সেই সময়ের প্রচলিত কঠোর বিচ্ছিন্নতার কারণে, অনেকেই উত্তর ম্যানহাটনের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায়শই আফ্রিকান আমেরিকান বা পুয়ের্তো রিকান মহিলাদের বিয়ে করতেন তারা। বেশ কিছু বাঙালি জাহাজ জাম্পার পরে অটো শিল্পে কাজ করার জন্য ডেট্রয়টে চলে যায়।
হাবিব উল্লাহর গল্প পুনরুদ্ধার করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি ছিল যে: তার বয়ষ যখন ৫০ বছর তখন তার ছেলে আলাদিনের জন্ম হয়েছিল এবং তার ছেলের বয়স যখন খুব কম তখনই তিনি মারা গিয়েছিলেন। এ বিষয়টি প্রমাণের মধ্য দিয়ে বল্ড এবং আলাদিন উল্লাহ নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, হাবিব উল্লাহ সম্ভবত ১৯০০ এর দশকের শুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কিশোর বয়সে নিউইয়র্কে এসেছিলেন।
১৯২০-এর দশকে আগত জাহাজ জাম্পারদের বিচরণস্থল পুনরুদ্ধার করার আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল। হারলেমের মতো আশেপাশের এলাকাগুলি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ‘কিছু চিহ্ন রয়েছে, কিছু ভবন এখনও আছে, কিছু নেই’-বল্ড বলেন। কারণ জাহাজ জাম্পাররা প্রায় সবসময় আফ্রিকান আমেরিকান এবং পুয়ের্তো রিকান পাড়ায় বাস করত, তাদের বাড়ি এবং সম্প্রদায়গুলি প্রায়শই ধনীক শ্রেণীর পরোক্ষ চাপ এবং বাস্তুচ্যুতির মতো বিষয়গুলো দ্বারা প্রভাবিত হতো। ‘এটি সেই উপায়গুলির মধ্যে একটি ছিল, যেখানে দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান ইতিহাস আফ্রিকান আমেরিকান এবং পুয়ের্তো রিকানদের সঙ্গে জড়িত।’
এশিয়ান আমেরিকান মিডিয়া সেন্টার থেকে প্রাপ্ত অনুদানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাক্ষাৎকার ও গবেষণার পর ‘বেঙ্গলি হারলেম’ একাধাওে গ্রন্থ ওপ্রামাণ্যচিত্রের জন্য চিত্রগ্রহণ করা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে জনাব হাবিব উল্লাহর যুগের সর্বশেষ জীবিত জাহাজ জাম্পারদের একজন, মাওসুদ চৌধুরী, যিনি ২০১০ সালে মৃত্যুর আগে বল্ডের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিলেন।
‘বেঙ্গল হারলেম’ নিয়ে বল্ড তার গবেষণামূলক গ্রন্থে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে, ২০ শতকের প্রথম দিকের বাঙালি জাহাজ জাম্পারদের গল্প পর্দায় আনার ফলে গত ১৫০ বছর ধরে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকানরা করে আসছিল, তা নিয়ে এখন তাদেরকে পুনর্বিবেচনা করতে অনুপ্রাণিত করবে।
সূত্র: এনবিসি নিউজ