গত প্রায় পাঁচ দশকে মক্কা নগরীর পরিবহন খাতের উন্নয়নে নানা ধরনের উদ্ভাবনী ধারণা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শহরটির নান্দনিকতায় ব্যাপকমাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ফলে সারা পৃথিবী থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের যাতায়াত ও চলাচল আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজসাধ্য ও নির্বিঘœ হয়েছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, কোনোরকম ঝামেলা ও ঝুঁকি ছাড়া হজ্বযাত্রীদের যাতায়াত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মক্কা নগরী তার বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।
মক্কা নগরীর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন গবেষকের নাম ড. সামির বারকা। তিনি বলছেন, হজ্ব পালন করার জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আদেশ পাওয়ার পর থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পায়ে হেঁটে, ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চড়ে মক্কায় আসতো।
‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহনের বিকাশ ঘটেছে। মানুষ মক্কায় পৌঁছানোর জন্য মাসের পর মাস হেঁটে যেতেন, তাদের মধ্যে অনেকে পথেই মারা যেতেন। তারপর মানুষ উট ব্যবহার করতে শুরু করে, যা মরুভূমির জাহাজ নামেও পরিচিত। তারপর নারীদের বহন করার জন্য ‘হাওদাস’ ও কাবাকে আবৃত করার জন্য কিসওয়া উদ্ভাবন করা হলো। উটের যাত্রাপথগুলি এই রুটের গুরুত্বের সাক্ষ্য বহন করে’-বলেন ড. সামির।
মূলত তেল আবিষ্কারের পর থেকে মক্কার পরিবহন খাতে বিশাল বিপ্লব ঘটেছে। এর ফলে গাড়ি, বাস, বিমান ও ট্রেনের ব্যবহার শুরু হয়। আজ যারা এখানকার পরিবহন চিত্র দেখবে, তারা স্পষ্টভাবে পার্থক্য করতে পারবে এবং উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দেখতে পাবে, বিশেষ করে গত ১০০ বছরের।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় গাইড ও লেখক তারেক আল থাকাফি বলেন, ‘হজ্বযাত্রীদের গাইড হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হজ্বের উন্নয়নকে তুলে ধরে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। প্রদর্শনীতে পরিবহন খাতের পরিক্রমা তুলে ধরার জন্য একটি বিশেষ প্যাভিলিয়ন অন্তর্ভূক্তি ছিল, যেখানে এ বিষয়ক চিত্র রয়েছে। মূলত এই চিত্রগুলি পরিবহন খাতের বিকাশ সম্পর্কিত ইতিহাসের পুরো চিত্র তুলে ধরে।’
মক্কার পরিবহন খাতের একজন বিনিয়োগকারী সাদ আল কুরাশি। তিনি জানিয়েছেন যে, মক্কার পরিবহন খাত একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে। আল কুরাশি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: মক্কার পরিবহন খাতের উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবেই হয়েছে এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
তার ব্যাখ্যা, মক্কা এমন একটি শহর যেটি সারা বিশ্ব থেকে আগত লাখ লাখ মুসলমানকে গ্রহণ করে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের যাতায়াত সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ মানের বাস সেবা চালু করা হয়েছিল। তার দাবি, এর মধ্য দিয়ে মক্কা শহর একটি বড় চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। ‘আমাদের কাছে হারামাইন ট্রেন, হলি সাইট ট্রেন ও পাবলিক শাটল-বাস পরিবহনও রয়েছে। যেগুলো সবই দর্শণার্থী ও তীর্থযাত্রীদেও সেবা দিতে অবদান রাখে’-আল কুরাশি।
গবেষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও মক্কা শহরের পরিবহন খাতের উন্নয়ন অতোটা সহজ ছিল না। এর অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে অন্যান্য শহর থেকে মক্কা নগরীর ভৌগলিক ও ভূমির বৈশিষ্ট্য একেবারেই আলাদা। আদতে এ শহরের ভূমির বেশিরভাগ অংশই কঠিন। ভূমির এই বৈশিষ্ট্যের কারণটিও অতীতে গ্র্যান্ড মসজিদের চারপাশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রবেশের সুবিধার্থে পাহাড় কাটার কাজটিকে বড় চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছিল।
আল কুরাশি বলছিলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল রুক্ষ পাহাড়গুলিকে সুড়ঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতা, যা কিনা মক্কার সমস্ত অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে।’ এই পর্বতগুলির উচ্চতা, গঠন ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা এবং পাহাড়ের বিপরীত দিকে পৌঁছানোর প্রতিবন্ধকতার মতো বিষয়গুলিকে অতিক্রম করা ছিল খুবই ক্লান্তিকর, দুঃসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ।
সরকারি সংস্থাগুলি এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার জন্য উদ্ভাবনী উপায়, পদ্ধতি এবং সমাধানগুলি অনুসন্ধান করেছিল, যার ফলে পাহাড়ের মধ্যে টানেল নির্মাণের ধারণা তৈরি হয়েছিল। আল কুরাশি বলেন, ‘পাবলিক বাস-শাটল পরিবহন প্রকল্প তিন দশক আগে তীর্থস্থানগুলিতে বাস্তবায়িত হয়েছিল। যা যানজট থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক পরিবহন ব্যবস্থায় অবদান রেখেছিল।’
মক্কা নগর নিয়ে যারা বিষদ পরিকল্পনা করছেন, তাদের প্রত্যাশা, মক্কা এখন তার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরো সংগঠিত করা এবং একটি উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অ্যাপ্লিকেশনসহ একটি স্মার্ট সিটি হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের চলাচলকে আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ করে তুলতে সক্ষম হবে।
সূত্র: আরব নিউজ