চলতি মাসের শুরুতে গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তে ১৯ জন অভিবাসন প্রত্যাশী মারা যায়। এরপর থেকে আঙ্কারা ও এথেন্স একে অপরের বিরুদ্ধে এই মৃত্যুর দোষ চাপিয়ে আসছে। যদিও এই মানুষগুলো আসলে কীভাবে এরকম পরিস্থিতির শিকার হলো, তা নিয়ে দুই দেশের কেউই কোনো রকম তথ্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সোয়েলু তার টুইটার অ্যাকাউন্টে চারটি ‘ বিরক্তিকর ছবি’ প্রকাশ করেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছিলো, কিছু মানুষ, আপাতত অচেতন অবস্থায় কোনো একটি জায়গায় ট্রাকভর্তি একটি আবর্জনার স্তুপের মাঝে পড়ে আছে। টুইট বার্তায় সোয়েলু লিখেছেন, ‘২২ জন অভিবাসীর মধ্যে ১২ জনকে পুশব্যাক করেছে গ্রিক বর্ডার ইউনিট। তাদের জামাকাপড় ও জুতা ছিনিয়ে নেয়ায় তারা হিমায়িত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ইইউ প্রতিকারহীন, দুর্বল এবং মানবিক অনুভূতিহীন।’
গ্রিক মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলাম মিনিস্টার নোটিজ মিতারাচি এর প্রতিক্রিয়ায় কী বলেছেন, তা নিয়ে আমি আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত করবো না। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘তুরস্কে যে মর্মান্তিক ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, সে বিষয়ে তুর্কি নেতৃত্বের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। অবৈধ বহির্গমন রোধ করা তুরস্কের দায়িত্ব।’
মিতারাচি কীভাবে নিশ্চিত হলেন তা এখনো অস্পষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রিক মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র ডয়েচেভেলেকে বলেছে যে, ‘এই মানুষদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো রেকর্ড নেই।’তবে এও প্রমাণিত হয় না যে, ভুক্তভোগীরা গ্রিসের মাটিতে পা রেখেছিল কিনা। একইসঙ্গে, গ্রিসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতার ক্ষেত্রে এখনো কোনো রকম প্রমাণাদি দেয়নি। একই সময়ে সীমান্তবর্তী ইভ্রোস নদীর কাছ থেকে আরো সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৯ এ।
স্বচ্ছতার অভাব
স্বাধীন গবেষক লেনা কারামিন্দোউ উভয়পক্ষের কাউকেই বিশ্বাস করতে নারাজ। তিনি মনে করেন যে, অনেক অভিযোগ এবং স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এ গবেষক ইভ্রোস অঞ্চলে বড় হয়েছেন, তিনি বর্তমানে গ্লাসগোয় রয়েছেন এবং বহু বছর ধরে গ্রিক-তুর্কি সীমান্তে অভিবাসন গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন।
কারমিন্দোউ উল্লেখ করছেন যে, ইভ্রোস অঞ্চলে ১৯৮০ এর দশকে পুশব্যাকের ইতিহাস রয়েছে। তিনি ডয়েচেভেলেকে বলেন, সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা বা পুশব্যাকের সময় থেকে মানুষ নিয়মিত তাদের প্রাণ হারানো শুরু করে। ‘এই ঘটনার অস্বাভাবিক বিষয়টি এই নয় যে, মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছে।’তিনি ব্যাখ্যা করছেন, ‘কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।’
গ্রিসে অভিবাসন-বিরোধী মনোভাব বেড়েছে
কারামিন্দাউ গ্রিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদত্ত ‘ভুক্তভোগীরা গ্রিসে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে’ বিষয়ক এমন তত্ত্বটি প্রকাশ করছেন না। ‘মানবাধিকার সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের একাধিক প্রতিবেদন থেকে আমরা জানি যে, সীমান্ত পাড়ি দেয়া ব্যক্তিরা অগত্যা নিবন্ধিত হয় না, বিশেষ করে পুশব্যাক করার আগে।’ তিনি বলেছেন যে, গ্রিসে অভিবাসন নিয়ে রাজনৈতিক ডিসকোর্স সবসময়ই ‘বিদ্বেষী, জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী।’ তারওপর আবার সেই অভিবাসী বিরোধী মনোভাব গত দুই বছরে তীব্র হয়েছে।
কারামিন্দাউ সমালোচনা করে বলেছেন যে, সরকার ও সরকারের ঘনিষ্ঠ মূলধারার মিডিয়াগুলি এর জন্য দায়ী। তারা সক্রিয়ভাবে এই জাতীয় ডিসকোর্স উপস্থাপন করে যে, অভিবাসন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ যা মূলত তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কারামিন্দাউ এর মতে, আশ্রয়প্রার্থীদের পুঁজি করে এথেন্স ও আঙ্কারার মধ্যে চলমান এই প্রচারণা যুদ্ধ ধাবমান হচ্ছে এবং উভয় দেশের মধ্যে এই ইতিহাস দীর্ঘ সময় ধরে বলবৎ। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, এ ধরণের শত্রুতার ন্যারেটিভ উপস্থাপনের মাধ্যমেই গ্রিস ও তুর্কি জাতীয়তা নির্ধারিত হচ্ছে […] দীর্ঘকাল ধরে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ না করা বা অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা না করার জন্য তুরস্ককে দোষারোপ করে আসছে গ্রিস।
অভিবাসন নীতি নিয়ে বিভক্ত ইইউ
অভিবাসন নিয়ে একটি সাধারণ ঐক্যমতে পৌঁছানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশসমুহ নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিছু সদস্য রাষ্ট্র আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণ না করার ব্যাপারে এখনো অনাগ্রহী। এর ফলাফল হিসেবে, ইইউ এখন তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে।
গ্রিসের নাম উল্লেখ করে দেশটির অবৈধ পুশব্যাক, আশ্রয় পদ্ধতির ওপর দেশটির অনিয়ম ও অভিবাসীদের ওপর পুলিশি হেনস্তার মতো বিষয় নিয়ে অসংখ্য সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ এতসব প্রমাণাদি এবং ইইউ থেকে প্রাপ্ত তহবিলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বেশ কিছু তথ্যাদি থাকা স্বত্বেও ইইউ কমিশনার ফর হোম অ্যাফেয়ার্স ইলভা জোহানসন আনুষ্ঠানিকভাবে এথেন্সকে তিরস্কার বা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তার একমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল ‘বড় উদ্বেগের বিষয়’- এই বাক্যটি প্রকাশ করা।
জেনেবুঝে সঠিক সময়ে টুইট?
ফ্রান্সের লিলেয়তে ইউরোপীয় স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীদের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালীন গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তে মারা যাওয়া অভিবাসীদের সম্পর্কে সোয়লুর টুইটটি এসেছিল। এই বৈঠকে জোহানসন ও মিতারাচি উভয়ই উপস্থিত ছিলেন। তার এই বক্তব্য আঙ্কারা ও এথেন্স এবং এথেন্স ও ইইউ এর মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এটা ভাবতে সত্যি অবাক লাগে যে, মিটিং চলার সময়ও সোয়লুর টুইটের মধ্যে কি না কাকতালীয় ব্যাপার ছিল!
গ্রিক-তুর্কি সীমান্তের ওই ঘটনা প্রসঙ্গে এক সান্ধ্যকালীন সংবাদ সম্মেলনে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন কমিশনার জোহানসন বলেছিলেন, ‘নিজেদের জীবন হারিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার চেষ্টা করা এই অভিবাসীদের উচিত ছিল না।’
তিনি যোগ করেন, মিতারাচি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, এই ভুক্তভোগীরা গ্রিসে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তিনি বলেছেন, এই ঘটনার অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ডয়েচেভেলে এই তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে তার অফিসে যোগাযোগ করেছিল কিন্তু কমিশনারের সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হয়নি।
অভিবাসীদের মৃত্যু নিয়ে জার্মানির প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকার সংগঠনগুলি আশা করেছিল যে, জার্মানির নতুন সরকার এবং এর গ্রিন পার্টি থেকে সদ্য দায়িত্ব নেয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনাালেনা বেয়ারবক ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহিরাগত সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো সোচ্চার হবেন।
জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর অভিবাসীদের মৃত্যুর বিষয়ে একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, ‘ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ।’
বিশেষজ্ঞরা গ্রিসে একটি স্বাধীন সীমান্ত-পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি চালুর দাবি করে আসছেন। যা সেখানকার কর্তৃপক্ষকে নিয়ম মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এথেন্স অবশ্য এই ধরনের ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে বলছে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর ডয়েচেভেলেকে জানিয়েছে, জার্মান সরকার ‘সাধারণত একটি স্বাধীন সীমান্ত ব্যবস্থা স্থাপন এবং এনজিওগুলিকেও বহিরাগত সীমান্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রবেশাধিকার দেয়ার বিষয়ে সমর্থন করে।
লেখক: ফ্লোরিয়ান শ্মিটজ, ডয়েচেভেলে