সম্প্রতি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, খুলনা থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন উপসহকারী পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৬ সালে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, রাজশাহীতে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ তিন যুগ কাজ করেছেন অভিবাসীদের নিয়ে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে একাধিক জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস এবং বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্ক পর্যন্ত ছিলো তার কাজের পরিধি। ফলে অভিবাসন বিষয়ে নিজ চোখে দেখা বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে তার পুরো কর্মজীবনে। এরকম নানা বিষয় নিয়ে গত বুধবার অভিবাসী ডটকম এর মুখোমুখি হন জনাব শেখ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অভিবাসী ডটকম এর নির্বাহী সম্পাদক রুবেল পারভেজ।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে যোগদানের মধ্য দিয়ে আপনার কর্ম জীবন শুরু হয়, এ বিষয়ে জানতে চাই।
২০-০৮-১৯৮৬ সালে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, রাজশাহীতে জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। ওখানে দীর্ঘ ১৭ বছর কাজ করেছি। আমার পদের নাম জরিপ কর্মকর্তা হলেও প্রবাসীদের নিয়ে নানা ধরনের কাজ করতে হতো আমাকে। ২০০১ সালে বদলি হয়ে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, যশোর-এ যোগদান করি। এরপর তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কে চার বছর টানা দায়িত্ব পালন করেছি। পর্যায়ক্রমে অ্যারাইভাল ডেস্ক, ডিপারচার ডেস্ক ও হ্যাঙ্গার গেটে (যে গেট দিয়ে মালামাল ও মরদেহ হস্তান্তর করা হয়) কাজ করেছি।
বিমান বন্দরে কী কী কাজ করতেন?
নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে সরকারি নির্দেশনা অনুসরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের মরদেহ গ্রহণ ও সেগুলো আত্মীয় স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করতাম। একইসঙ্গে কাগজপত্র পরীক্ষার মাধ্যমে স্বজনদের হাতে অনুদান তুলে দিতাম।
আপনার দেখায় কী পরিমাণ মরদেহ প্রতিদিন হস্তান্তর করা হতো?
আমার দায়িত্ব পালনের সময়কালে বিদেশ থেকে প্রতিদিন সর্বনিম্ন পাঁচ জন প্রবাসী বাংলাদেশির মরদেহ বিমান বন্দরে আসতে দেখেছি। এ সংখ্যা আমি নিজ চোখে কখনো কখনো ৫০, ৬০ কিংবা সর্বোচ্চ ৭০ জন পর্যন্ত দেখেছি এবং গ্রহণ করেছি। আসলে হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে যে কত শত প্রবাসীদের মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দিয়েছি, তার হিসাব নেই। এসময় মরদেহ যারা বুঝে নিতে আসতো, তাদেরকে তথা মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনদের কাছে চেক বিতরণ করেছি।
রাত নেই, দিন নেই-এ কাজ করেছি। সোজা কথা, বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। আমার মতো এতদিন কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিমান বন্দরের ডেস্কে কাজ করেছেন বলে জানা নেই। ২০০৭ সাল থেকে টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত ওখানে কাজ করেছি।
হ্যাঙ্গার গেট থেকে মরদেহ বের হওয়ার পর আর কী কী করতেন?
হ্যাঙ্গার গেট থেকে লাশ বাইরে বের হওয়ার পর ঠিক পাশেই হিমঘরে রাখা হতো। ওখানে লাশের কফিনগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকে। এখানে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই মৃতের আত্মীয়স্বজন মরদেহ সনাক্ত করতে পারতো না। তখন আমাদের কাছে সাহায্য চাওয়া মাত্র সহযোগিতা করি। মরদেহ সনাক্তের পর আমরা কাগজপত্র সবকিছু পরীক্ষা করে তা বুঝিয়ে দিতাম।
চোখের সামনেই প্রতিদিন মরদেহ আসতো, সেগুলো আবার পরিবারের সদস্যদের কাছে বুঝিয়ে দিতেন। মানসিকভাবে তো আপনার ওপর প্রভাব পরার কথা।
অবশ্যই, খুবই দুঃখজনক স্মৃতি সেগুলো। মানসিকভাবে আমার ওপর অনেক চাপ পড়তো। চোখের সামনে এত এত মরদেহ পড়ে থাকা দেখার দৃশ্য কতোটা কঠিন আর করুণ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বৃদ্ধ পিতা মাতা, ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানসহ যেসব আত্মীয়স্বজন যখন মরদেহ গ্রহণ করতে আসতো তখন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটতো। অসহায়র্ত মানুষগুলোর ক্রন্দন আর চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠতো। আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও তো স্বজন আছে, এ দৃশ্য দেখে আমাদের কাছে খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু উপায় নেই। ওটাই আমার দায়িত্ব ছিলো। প্রতিদিনই কাজটা করতে হতো। এই খারাপ লাগার মধ্যেই মরদেহবাহী কফিনগুলো আমাদের সামনেই খুলতো। কফিন খুলে কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিতাম।
এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব পালন করাটা কতোটা চ্যালেঞ্জের বলে মনে করেন?
মরদেহগুলোর কথা মনে পরা মাত্রই চোখ দিয়ে পানি চলে আসতো। মা বাবা আত্মীয়স্বজনদের কান্না নিবারণের চেষ্টা করেছি, দুঃখ প্রকাশ করেছি। আবার এর মধ্যেই নিয়ম মেনে তাদেরকে বুঝিয়ে বলতাম বৈধভাবে বিদেশে গিয়ে কেউ মারা গেলে, পরিবার প্রতি বাংলাদেশ সরকার তিন লাখ টাকা অনুদান দেয়। আর যারা দুর্ঘটনায় মারা যায়, বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়। মামলায় জিতে গেলে ৫০ থেকে ১ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আবেগ আর দায়িত্ব-এই দুই রকম পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই কষ্টকর।
অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ চেনার উপায় থাকে না। এরকম বিভৎস কোনো স্মৃতি আছে আপনার?
বিশেষ করে যারা আগুনে পুড়ে মারা যেতো, তাদের মরদেহ দেখাটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ছিলো। খুবই বিভৎস সে দৃশ্য। এরকম বেশিরভাগ মরদেহবাহী কফিন খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকতো। তারপরও আত্মীয় স্বজনের অনুরোধে দুয়েকটি খোলা হতো, সেগুলো আসলে দেখার মতো না। মুখের আকৃতি বোঝা যেতো না, সনাক্তকরণই কষ্টকর হয়ে যেতো। কাঠ পুড়ে যেভাবে কয়লা হয়, সেরকম মরদেহও নিজ চোখে দেখেছি।
এরকম দৃশ্য দেখার পর দিনের পর দিন হঠাৎ হঠাৎ করে চোখের সামনে সেগুলো ভেসে উঠতো, ঘুমানোর মধ্যে মনে পড়তো, জেগে উঠতাম আতঙ্কে। এমনও হয়েছে ভাত খাওয়ার সময় মনে পড়েছে, তখন আর খেতে পারতাম না।
মৃতের পরিবারের সঙ্গে যেরকম কথাবার্তা আপনার হতো…
খুব বেশি কথাবার্তা হতো না। বেশিরভাগ সময় তারা শোকাহত থাকতো। মূলত মরদেহ নেয়ার জন্যই আমাদের কাছে আসতো। তারপরও আমরা কিছু আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলতাম। কীভাবে আবেদন করলে তারা টাকা পয়সা পাবে, কোথায় কোথায় যাবে-এরকম নানা ধরনের পরামর্শ দিতাম।
বলছিলেন, এই কাজগুলো করতে গিয়ে অনেক সময় ঘুমাতে পারতেন না, ভাত খেতে পারতেন না। তারপরও তাদের পাশে থাকার বিষয়টি আপনাকে কতটা ভালো লাগায়?
খুবই ভালো লাগে যে, এক জীবনে এই রকম অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পেরেছি, সেবা করতে পেরেছি। আমার জীবনে কখনো কোনো অভিপ্রায় ছিলো না যে, তাদের কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধা নেবো। অনেকে অনেক সুবিধা নিলেও আমি প্রবাসীদের কাছ থেকে কখনো এরকম কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ নিইনি।
তারা বলতো, আমার সহযোগিতা পেয়ে তারা ধন্য, খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো। এমনও বলেছে, স্যার আপনি চলেন আমাদের সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে কিছু খান, নাস্তা করেন। আমি বলেছি, না। আপনাদের সেবা করতে পেরেই আমি তৃপ্ত। এটাই আমার কাছে ভালো লাগার এবং বড় পাওয়া।
আমি জীবনে তাদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিইনি, কামনাও করিনি এবং তারা দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। সরাসরি বলে দিয়েছি, আমি এটা পছন্দ করি না। কারণ আমি আপনাদের যে সহযোগিতা করেছি, এর বিনিময়ে সরকার আমাকে যথেষ্ট বেতনাদি দেয়। সবাই অবগত যে, বিমানবন্দরে অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।
কিন্তু ওখানে চার বছরের জীবনে আমাকে উল্টো সবাই ভয় পেতো। বলতো ওমুক স্যার আসছে, এই মুহূর্তে এসব করা যাবে না, দুই নাম্বারি করে লোক পাঠানো যাবে না। কারণ উনি সবকিছু চেক করবেন এবং ধরা পড়লে সমস্যা হবে। এমনও দেখা গেছে, বিমানের টিকিট কেটেও তা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। আসলে ওরা আমার সততাকে ভয় পেতো।
আপনার কী মনে হয়, আপনার এই নৈতিকতার বোধটুকু যদি সবার মধ্যে থাকতো তাহলে নিরাপদ অভিবাসন আরো নিশ্চিত হতো?
অনেক অনেক ভালো হতো। কারণ অনেকের ভেতর এই ধরনের সততা নেই, এই শুভ চিন্তা করার শক্তিটুকু নেই। অনেকের কাছে আর্থিক সন্তুষ্টই জীবনের লক্ষ্য। আর আমি মনে করতাম, সেবাই আমার জীবনের মূল লক্ষ্য। সরকার যতটুকু আমাকে দিয়েছে ততটুকুই আমার প্রাপ্য।
আরো পড়ুন: ‘একজন অভিবাসী নারীও নিপীড়িত হবে না, এটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে’
খুলনার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে কত বছর চাকরি করেছেন?
ঢাকা থেকে যশোর এবং এরপর খুলনায় আসলাম ২০১৩ সালে। তবে সাতক্ষীরায় কিছুদিন অফিস করেছি। ওখানে অফিস প্রধান (সহকারী পরিচালক) ছিলাম। কিন্তু আমি ওখানে থাকবো না বলে খুব দ্রুত ঢাকায় যোগাযোগ করে খুলনা চলে আসি। কারণ অফিস প্রধান হতে আমি চাইনি।
অফিস প্রধান তো সবাই হতে চায়, আপনি চাইলেন না কেনো?
কারণ, কিছুকিছু কাজ ছিলো, যেগুলো আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিলো না। ঢাকা থেকেও আপনার মতো বলেছিলো, সবাই অফিস প্রধান হতে চায়। আর আপনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন? সত্যি বলতে কী, আগে থেকে যারা ওখানে ছিলো, তাদের বিভিন্ন যোগসূত্রতা তো গড়ে উঠেছিলো। এখন আমার পক্ষে তো ওসব করা সম্ভব নয়। আমি নিজে পেছন থেকে কিছু নিই না, কাউকে দিও না। তো এরকম বৃথা ঝামেলার মধ্যে না থেকে সরে আসাটাই শ্রেয় মনে করেছি।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলুন, জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসগুলোর কোন কোন জায়গায় উন্নত করা দরকার?
প্রথমত, সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে, নজরদারি বেশি বাড়াতে হবে। অফিসের কাজগুলো সুশৃঙ্খলভাবে করতে হবে। যদিও অফিসের কর্মী সংখ্যা কম; ২১ জন থেকে এখন আছে ৯-১০ জনে এসে ঠেকেছে। এত কম সংখ্যক মানুষের পক্ষে কাজ করা কঠিন। চিঠিপত্র আদান প্রদানের গতি এখনো মন্থর। এগুলোকে আপডেট করতে পারলে ভালো হয়। বিশেষ করে অনলাইনে করতে পারলে অসুবিধাগুলো দূর হতো, সময় বাঁচতো।
অন্যদিকে বিদেশে যারা সমস্যায় আছে, তাদের অভিযোগগুলোর ব্যাপারে বিএমইটির আরেকটু তড়িৎ হওয়া উচিৎ। ওখানে সময় বেশি লাগে। ওখানকার কর্মকর্তাদের আরেকটু দ্রুততার সঙ্গে এ কাজগুলো করা উচিৎ।
আরো পড়ুন: লড়াইটা অভিবাসীদের মর্যাদা রক্ষার: রায়হান কবির
১৯৮৬ থেকে ২০২৩-পুরো এই পথচলার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলুন, অভিবাসন বিষয়ক তথ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে কতোটা পরিবর্তন ঘটেছে?
অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছে, অনেক কিছু জানছে। আগের চেয়ে তুলনামূলক মানুষের ভোগান্তি কমেছে। এখন অনলাইনে অনেক কিছুই দেখা যায়, এখান থেকে তারা অনেক তথ্য জানতে পারে। তবে আরেকটু সতর্ক হলে ভালো হয়। বিশেষ করে ডেমোর অসুবিধাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে বিএমইটি ডেমোকে কম গুরুত্ব দেয়। মানে তারা যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়, ওটাই যথেষ্ট বলে তারা মনে করে। কিন্তু আমার মনে হয, ডেমোর গুরুত্ব অনেক। তাদের কাছ থেকেই প্রথম অভিজ্ঞতাটুকু নেয়া উচিৎ। কারণ একমাত্র ডেমোই মাঠপর্যায়ে কাজ করে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদেরই বেশি সম্পর্ক ও জানাশোনা।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে আর কি কি বিষয়ের উন্নয়ন দেখলে তৃপ্ত হতেন?
যেসব জেলায় এখনো জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস হয়নি, সেসব জায়গায় এ অফিসগুলো হওয়া জরুরী। সারা বাংলাদেশে ডেমো অফিস থাকলে অভিবাসীরা আরো বেশি সহজে নিরাপদ অভিবাসন করতে পারবে।
অভিবাসী ডটকম এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ
আপনাকে ধন্যবাদ।