বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব তৈরিতে হিজাব কতোটা দায়ী?

কেন কিছু ইউরোপীয়, মুসলিম অভিবাসীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে এবং কীভাবে এই কুসংস্কারকে কমানো যায়? রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিকোলাস সাম্বানিস এ বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে জার্মানি জুড়ে গবেষণা চালিয়েছেন।

তিনি সম্প্রতি ট্রেন স্টেশনে ইচ্ছুক অংশগ্রহণকারীদের এবং প্রতক্ষ্যদর্শীদেরকে সম্পৃক্ত করে একটি উদ্ভাবনী গবেষণা চালিয়ে এই প্রশ্নটি অনুসন্ধান করেছেন।

‘হিজাবের প্রভাব’: জার্মানিতে মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি নারীবাদী প্রতিক্রিয়া’ বিষয়ক গবেষণা

এই গবেষণায় তারা দেখিয়েছেন যে, মুসলিম নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তখনই কমে যায়, যখন তারা প্রগতিশীল লিঙ্গ মনোভাব দেখায়।

নিকোলাস সাম্বানির সহ-গবেষক হিসেবে কাজ  করেছেন পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডংহিউন ড্যানি চোই এবং টেক্সাস এর অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথিয়াস পোয়ার্টনার।

তাদের এই নতুন গবেষণাটি আমেরিকান জার্নাল অব পলিটিক্যাল সায়েন্সে গত ৪ জুলাই প্রকাশিত হয়।

তারা গবেষণাটিতে স্থানীয় জার্মানদের সঙ্গে দৈনন্দিন কথোপকথনের সময় মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া বৈষম্যের প্রমাণ পেয়েছেন। জার্মানির কয়েক ডজন শহরের বিভিন্ন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে।

গবেষণাটিতে আরো প্রকাশিত হয়েছে যে, জার্মান নারীরা বিশ্বাস করেন যে, মুসলিম নারীরা নারীবাদের বা নারী অধিকারের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব পোষণ করে থাকেন, আর এই বিশ্বাসই মুসলিম নারীদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে।

ছবি: আই আর আই সি

প্রকৃতপক্ষে, তাদের গবেষণায় মুসলমানদের প্রতি নারীবাদী বিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায় এবং দেখা যায় যে, ইউরোপীয়ানদের সন্দেহ তখনই দূর হয় যখন মুসলিম নারীরা বোঝাতে পারেন যে, তারা প্রগতিশীল লিঙ্গ মনোভাবের প্রতি বিশ্বাসী।

সাম্বানিস বলেন, মনোবিজ্ঞানের অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পক্ষপাত এবং বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট জাতিগত বা ধর্মীয় পার্থক্য নাগরিকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে।

‘সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের যে ঢেউ ইউরোপে তৈরি হয়েছে তার সম্মুখীন হয়ে অনেক ইউরোপীয়রা ক্রমবর্ধমান একত্রীকরণের নীতিগুলিকে সমর্থন করছে। আর এই একত্রীকরণ নীতি মূলত জাতিগত বা ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি প্রকাশের বৈচিত্র‌তাকে মুছে ফেলতে চায়।’

তিনি উদাহরণস্বরূপ জনসম্মুখে হিজাব নিষিদ্ধ করা বা অভিবাসীদের ভাষা শিখতে বাধ্য করার মতো বিষয়গুলোকে উল্লেখ করেন। সাম্বানিস বলেছেন, ‘আমাদের গবেষণা প্রমান করছে যে পক্ষপাত এবং বৈষম্য অনেক কম জবরদস্তি পদক্ষেপের মাধ্যমে হ্রাস করা যেতে পারে-যতক্ষণ না অভিবাসন স্থানীয় জনসংখ্যার সামাজিক পরিচয় নির্ধারণকারী মৌলিক মূল্যবোধকে হুমকির মুখে ফেলে।’

নতুন রিপোর্টটি প্রকল্পের প্রথম ধাপে তৈরি হয় যা প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস -এ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেখানে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য আসলেই হ্রাস পেয়েছে কিনা সে বিষয়ক একটা অনুসন্ধান ছিল। গবেষণাটিতে উঠে আসে যে, যখন অভিবাসীরা স্থানীয় জনগুরুত্বপূর্ণ নাগরিক নীতিগুলি মেনে চলে, তখন তাদের প্রতি বৈষম্য কম হয় ।

তবে সেই গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, অভিবাসীরা নিয়মগুলো মেনে চললে তাদের প্রতি বৈষম্যের মাত্রা হ্রাস হয় বটে, কিন্তু তা পুরোপুরি দূর হয় না।

ছবি: আল জাজিরা

নতুন গবেষণায় স্থানীয় জার্মানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রীতিনীতির প্রভাব সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয় এবং অভিবাসীরা এই ধরণের নিয়ম-নীতি অনুসরণ করলে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ করা যায়।

সাম্বানিস বলছেন, ক্রমবর্ধমান অভিবাসনের যুগে স্থানীয় এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমানোর বিষয়ে কীভাবে চিন্তা করা যায় তার জন্য এই অনুসন্ধানের ভূমিকা রয়েছে।

তিনি এবং তার সহ-গবেষকগন জার্মানির ২৫ টি শহরে ৩,৭০০ এরও বেশি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে বৃহৎ পরিসরে এই নিরীক্ষণ পরিচালনা করেন।

সাম্বানিস বলছেন, ‘কেস স্টাডি হিসেবে জার্মানি একটি উপযুক্ত স্থান ছিল। কারণ সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শরণার্থী সংকটের ফলে, ২০১৫ সাল থেকে দেশটি ইউরোপের সর্বাধিক সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন গ্রহণ করেছে। ‘যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের প্রথম দিক থেকে জার্মানিতে মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

আবার সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ফলে এখানে অভিবাসী-বিরোধী মনোভাবও বেশি ছিল। এই পার্থক্যগুলি রাজনৈতিকভাবে হেরফের করা হয়, যার ফলে এই বিষয়গুলো আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি :

গবেষণায় সম্পৃক্ত একজন নারী একটি ট্রেন স্টেশনে বেঞ্চের কাছে অপেক্ষমান যাত্রীদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথা বলতেন।

তারপরে তিনি একটি ফোন কল রিসিভ করেন এবং তার বোনের বিষয়ে জার্মান ভাষায় কলকারীর সঙ্গে কথোপকথন করেছিলেন একটু উচ্চস্বরে, যেন তার পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা তার কথোপকথন শুনতে পায়।

কথোপকথনের বিষয়বস্তু ছিল তার বোনের চাকরিতে যুক্ত হওয়া নিয়ে। কিংবা চাকরি না করে বাড়িতে থেকে তার স্বামী ও বাচ্চাদের যত্ন নেবেন কিনা, এসব বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। মূলত গবেষণার জন্য স্ক্রিপ্টেড এই কথোপকথনে তার বোনের কাজ করার অধিকার আছে কিনা বা পরিবারের যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়িতে থাকার দায়িত্ব আছে কিনা সে বিষয়ে ফোন রিসিভ করা নারীটি তার অবস্থান প্রকাশ করছিলেন।

ছবি: আর পি-অনলাইন. ডি

ফোন কল শেষে, তার হাতে থাকা লেবুর ব্যাগটি তিনি ফেলে দেন, যেন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ব্যাগটি ছিড়ে পড়ে গেছে। সেসময় কিছু লেবু প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং সেগুলি সংগ্রহ করতে তার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল বলে মনে হচ্ছিল।

চূড়ান্ত ধাপে, দলের সদস্যরা যারা সরাসরি ঘটনার অংশ ছিলেন না, তারা পর্যবেক্ষণ করেন এবং লিপিবদ্ধ করেন যে ফোন কল এর কথোপকথন শুনতে পেয়েছেন  এমন প্রত্যক্ষদর্শীরা নারীটিকে লেবু সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছিল কিনা।

তারা পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন ধরণের নারীদের নিযুক্ত করেন, যারা কখনও কখনও স্থানীয় জার্মান বা মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী ছিলেন। আবার কখনও কখনও অভিবাসী নারীরা তার মুসলিম পরিচয়ের চিহ্নস্বরূপ হিজাব পরতেন এবং কিছু ক্ষেত্রে পরতেন না।

চূড়ান্ত ফলাফল

তারা দেখতে পেলেন যে, পুরুষরা লিঙ্গ সমতার প্রতি নারীর মনোভাব সম্পর্কিত বিভিন্ন বার্তার প্রতি খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু জার্মান নারীরা ছিলেন। জার্মান নারীদের মধ্যে, মুসলিম বিরোধী বৈষম্য তখনই দূর হয়েছিল যখন অভিবাসী নারীটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি নারীর অধিকার সম্পর্কে প্রগতিশীল মনোভাব পোষণ করেন।

কিন্তু পুরুষরা পরীক্ষার সময় প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রগতিশীল উভয় অবস্থাতেই বৈষম্য অব্যাহত রেখেছেন।

এটি একটি আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল যে, পরীক্ষামূলক পরিস্থিতি মুসলিম নারীদের প্রতি পুরুষদের আচরণের ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না।

পরীক্ষাটি লিঙ্গ পরিচয়কে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে এবং লিঙ্গ সম্পর্কে প্রগতিশীল  স্থনীয় জার্মান ও অভিবাসী নারীর মধ্যে একটি সাধারণ পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে ।

গবেষকরা বলছেন, এই ফলাফলটি বৈষম্য হ্রাসের একটি ভিত্তি হতে পারে এবং মুসলমানদের হিজাব খুলে দিতে বাধ্য করার মতো জোরপূর্বক পদক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই।

যে ফলাফলগুলি আমরা পেয়েছি তা পূর্বের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্চর্যজনকভাবে ভিন্ন, যেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে জাতি, ধর্ম এবং এগুলো থেকে সৃষ্ট বাধাগুলি অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে খুব কঠিন। একই সময়ে, এই পরীক্ষাটি বহুসংস্কৃতির সীমাবদ্ধতার কথা বলে- সাম্বানিসের অভিমত।

তিনি আরো বলেন ‘আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, জাতিগত, বর্ণগত বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্যগুলি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু নাগরিকরা অন্যদের মূল্যবোধকে উদারভাবে মেনে নিতে গিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের রীতি এবং ধারণাগুলি পরিত্যাগ করতে চাইবে না।

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা