বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান এর কল্পনায় বাংলাদেশের নারীরা অনেক বেশি সামর্থ্যবান, শক্তিশালী আর সাহসী। সুলতান তার রং-তুলির আঁচড়ে নারীর সুঠাম বাহু, শরীরের অবয়ব এঁকে প্রতীকী অর্থে বুঝিয়েছেন, যোগ্যতায় এদেশের নারীরা কারো চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, সমানে সমান।
সম্প্রতি ভর দুপুরে রাস্তা-লাগোয়া টইটুম্বুর একটি ডোবায় তিনজন নারীর মাছ ধরার অনবদ্য কৌশল দেখে সুলতানের সেই কল্পিত সামর্থ্যবান নারীদের দৃশ্যই চোখে ভেসে উঠলো
দেখা গেল, কোনো বড়শি, জাল বা মাছ শিকারের অন্য কোনো হাতিয়ার ছাড়া হাত দিয়েই কেজি কেজি মাছ ধরছে তারা। যদিও দূর থেকে তা কারো পক্ষে ঠাওর করা কোনোভাবে সম্ভব নয়। দূর থেকে দেখে মনে শুধু প্রশ্ন জাগতে পারে, পানির মধ্যে শরীরের প্রায় পুরোটা ডুবিয়ে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে কী করছে তারা?
কৌতুহলের জট খুলতে খুলনা-দাকোপ সড়ক ধরে এগিয়ে রানা রিসোর্ট নামের একটি বিনোদন কেন্দ্রের ঠিক আগে আইল ধরে সোজা চলে যাওয়া হয় ওই তিনজন নারীর কাছে। সামনে গিয়ে দেখা গেল, তাদের দুইজন বাঁশের তৈরী দুটি ঝুড়ির মুখ ও অন্যজন প্লাস্টিকের একটি গামলা জাল দিয়ে আটকে রেখেছেন। শুরুতে মনে হলো, তারা বোধহয়, শামুক তুলে তা পাত্রে রাখছেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ভুল ভাঙে। দেখা গেল, ওই তিন নারীর মধ্যে যিনি, বায়োজেষ্ঠ্য, তিনি প্রায় ১০ ইঞ্চি সমান একটি বেলে মাছ ধরে তা নিজের কোমরের সঙ্গে দঁড়ি দিয়ে বাধা বাঁশের ঝুড়িতে রাখছেন।
ঠিক এমন সময় অন্য দুইজন নারী একটি করে বড় টেংরা মাছ ধরে তা একইভাবে নিজেদের পাত্রে রাখলেন। মূলত জোয়ারের সময় এই মাছ নদীর তীরসংলগ্ন নালা দিয়ে এই ডোবায় ঢোকে। ভাটির সময় এগুলো আর বের হতে পারে না।
কাছে গিয়ে শুরুতে পরিচয় দিয়ে ওই তিন নারীর একজন মালতির দের সঙ্গে কথা হয়। চল্লিষোর্ধ এ নারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, কখন থেকে মাছ ধরছেন? ‘দুপুর ১২টা নাগাদ এসেছি। তখন থেকেই মাছ ধরছি’-বলেন তিনি। এরপর মাছ ধরার মধ্যেই, যিনি তাদের সবার চেয়ে জেষ্ঠ্য, তার কাছে প্রশ্ন করা হয়, কত বছর যাবৎ আপনি এখানে মাছ ধরেন? তিনি বলেন, ‘সেই ছোটোবেলা থেকেই মাছ ধরি। তবে, শুধু এখানে না আরো অনেক জায়গায় সময় সুযোগ পেলে মাছ ধরতে যাই।’
কথা প্রসঙ্গে এ নারীরা জানালেন, মূলত তারা মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে মাঠে কাজ করেন। ধানের মৌসুমে ধান চাষ, তরমুজের মৌসুমে তরমুজ চাষের সময় ঘণ্টা প্রতি ৫০-৬০ টাকা চুক্তিতে শ্রম দেন তারা। যখন এই কাজ থেকে সামান্য সময়ের জন্য ফুরসত মেলে, তখনই তারা একসঙ্গে মাছ ধরতে চলে আসেন।
এই মাছ বিক্রি করেন? শিপ্রা মণ্ডল নামের আরেকজন নারী দিলেন উত্তর: ‘যেদিন কম মাছ পাই সেদিন বিক্রি করি না, নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখি। আর যেদিন বেশি পাই সেদিন বিক্রি করে দিই।’
প্রায় ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে দেখা গেল, তাদের পাত্র বেলে, টেংরাসহ আরো কয়েক পদের মাছে ভরে গেছে। মোদ্দাকথা, এক একজনের পাত্রে কম করে হলেও তিন থেকে চার কেজি মাছ।
মূলত তারা মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে মাঠে কাজ করেন। ধানের মৌসুমে ধান চাষ, তরমুজের মৌসুমে তরমুজ চাষের সময় ঘণ্টা প্রতি ৫০-৬০ টাকা চুক্তিতে শ্রম দেন তারা। যখন এই কাজ থেকে ফুরসত মেলে, তখনই তারা একসঙ্গে মাছ ধরতে চলে আসেন
মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কোনো জাল, বড়শি, ছিপ বা অন্য কোনো হাতিয়ার ছাড়া শুধু হাত দিয়েই কেজির পর কেজি মাছ ধরে ফেলেছেন তারা। অল্প সময়ে এত বেশি মাছ ধরার এই দৃশ্য দেখে যে কোনো সাধারণ মানুষেরই অবাক হয়ে যাবার কথা। প্রশ্ন জাগার কথা, কোন যাদুর বলে এভাবে এত বেশি মাছ হাত দিয়ে ধরায় দক্ষ হয়ে উঠলেন তারা?
‘আমরা ছোটোবেলা থেকেই হাত দিয়ে মাছ ধরতে অভ্যস্ত। ধীরে ধীরে ধৈর্য্য ধরে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলি আর মাছ ধরি। কোনো তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আমার তো মনে হয়, জাল, বড়শির চেয়ে হাত দিয়েই মাছ ধরা সহজ!’-বলেন ষাটোর্ধ সেই বায়োজেষ্ঠ্য নারী।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, তারা প্রত্যেকেই পানি থেকে উঠে এসে বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানালেন, প্রখর রোদে অনেকক্ষণ ধরে মাছ ধরেছেন, এবার ক্ষুধা পেয়েছে, তাই বাড়ি যেতে হবে তাদের। এসময় প্রশ্ন করা হলো: এত মাছ পেলেন, আজ বিক্রি করবেন না? হেসে দিয়ে একজন বললেন, ‘করবো। খুচরা বিক্রেতারা এসে মাছ নিয়ে যাবে কেজি প্রতি ৩০০-৩৫০ টাকা দরে। যদিও আকার ও প্রজাতি ভেদে খুচরা বাজারে এ মাছ কম করে হলেও সাতশো টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।