নিলামে বাবা হারিয়েছেন সমস্ত সম্পতি। গর্ভে যখন তিন মাসের সন্তান তখন বাঘে খায় স্বামীকে। একটি ছেলে সন্তান রেখে একমাত্র মেয়ের স্বামীও মারা গেছে। অশীতিপর আমোদিনী প্রায় চার দশক ধরে কলার মোচা বিক্রি করেন বাজারের ফুটপাতে। বর্তমানে তার রোজ আয় সাকুল্যে ৪০-৫০ টাকা
আহা, মা-বাবা কী স্বপ্নই না দেখেছিলেন কেবলই পৃথিবী দেখা সন্তানকে ঘিরে। সুখে-আনন্দে গোটা জীবনটা পার করে নিজ নাম অর্থবহ করে তুলবে-এমন ভাবনা থেকেই হয়তো প্রিয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন আমোদিনী। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে সত্যিই কি আমোদিনী পেরেছেন, তাকে দেয়া বাবা-মার নামকে অর্থবহ করে তুলতে? নাকি গোটা জীবনটাই আমোদিনীর পেরিয়ে গেছে দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে?
প্রশ্নের উত্তর মিলবে খানিকটা এগোলে, প্রথমত চোখের দেখায়। অশীতিপর নারী আমোদিনী একজন খুচরা কলার মোচা বিক্রেতা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া গল্লামারি বাজারের ফুটপাতে হাতেগোনা কয়েকটি কলার মোচা বিক্রি করেন তিনি। রোজ ভোররাতে বাকি সবার ঘুম ভাঙার আগে আমোদিনী বস্তায় করে দশ-বারোটি কলার মোচা নিয়ে চলে আসেন বাজারে।
চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে সেগুলো বিক্রির চেষ্টা করেন আমোদিনী। বেঁচা-বিক্রি শেষে যাতায়াত ও মালামাল ক্রয় খরচ বাদে সাকুল্যে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয় তার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র এই ক’টি টাকার হিসাবও তিনি গুলিয়ে ফেলেন, ঠিক রাখতে পারেন না। ভুলে যান সবকিছু। তার পাশে থাকা অন্য দোকানিরা টাকাপয়সার হিসাব মিলিয়ে দেন। এমনকি অনুমান করেও বলতে পারেন না, নিজের বয়স কত! আমোদিনীর চোখ-মুখ-শরীরে বিষন্নতা, চিন্তা ও ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। একটু খেয়াল করে দেখলেই অনুমিত হয়, কোনো এক তীব্র মানসিক আঘাতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি।

বাবা-মার দেয়া নামকে কতোটা অর্থপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই উত্তর আরেকটু খোলাসা হবে আমোদিনীর নিজ বয়ানে:
অভিবাসী ডটকম: কত বছর ধরে কলার মোচা বিক্রি করেন?
আমোদিনী: বহুকাল।
কত বছর?
‘তা কি আর আমার মনে আছে? মাথায় করে অনেক দূর নিয়ে যাতাম। তখন কচুর লতি, শাক, থাককুনি পাতা…মেলা কিছু বেচতাম।’এখনো এ কাজ কেনো করেন?
করবো না! তা খাবো কী? নেই ব্যাটা ছাওয়াল (ছেলে সন্তান), নেই স্বামী। মাইয়েডা (মেয়ে) গোছায় (গুছিয়ে) দেয়, তাই নিয়ে বাজারে আসি।’
কথা বলতে বলতে কখন যে আমোদিনী দুঃখভেলার সওয়ার হয়ে যান, তা হয়তো ভুলেই গেছেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, ‘স্বামী নেই, ছাওয়াল নেই, বড় দুঃখ আমার, এই দুঃখ রাখার জায়গা নেই। এন্নে (এখন) আর পারিনে। কি শুনবা বাবা, আমার দুঃখের কথা শুধু হরিরেই কই।’
আমোদিনী এপর্যায়ে তার পৈতৃকবাড়ি, স্বামী কীভাবে মারা গেলেন, মেয়ের কী অবস্থা-সবই তুলে ধরেন অভিবাসী ডটকম এর কাছে। ‘আমার বাপের বাড়ি মঠবাড়ি, পাইকগাছা থানা। আমি বড়লোকের মাইয়ে। আমি ও পরিচয় আর দেবো না (কান্নাজড়িত কণ্ঠে)। আমার বাবা গ্রামের মাতুব্বর ছিল, অনেক জমিজমা ছিল। সরকাররে খাজনা দেয়নি, তাই সব নিলাম হয়ে গেইলো। এরপর যুদ্ধের সময় আমার বাবা-মা ভাতের জ্বালায় (অভাবে) খুলনা আইলো।’
স্বামীর মৃত্যু নিয়ে বিলাপ ঝরে আমোদিনীর কণ্ঠে। মনে হয়, এই তো মাত্রই মারা গেছেন তার জীবনসঙ্গী। ‘১৬ বিঘা জমি তিন কুড়ি টাকায় বন্ধক থুইলো আমার স্বামী। এরপর দেশে গণ্ডগোলের সময় (৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ) সব থুইয়ে (রেখে) চইলে গেলাম ইন্ডিয়া। ও পাশে গুলি মারে এই পাশে আইসে বসি। এই পাশে গুলি মারে, ওই পাশে যাইয়ে বসি। স্বাধীনের পর আমরা দেশে আসি। এরপর কয়েকজন লোক ওনাকে শত্রুতা কইরে বনে নিয়ে বাঘের গালে দিয়ে আসলো।’
আরো পড়ুন
‘আমি সারাদিন কাজ করে অভিবাসীদের স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাই’
আমোদিনী জানালেন, স্বামীর মৃত্যুর সময় তার গর্ভে ছিল তিন মাসের সন্তান। এরকম পরিস্থিতিতে উপায় না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। ‘মাইয়েরে কোলে কইরে নিয়ে পরের বাড়ি কাজ করিছি, খাইছি, রইছি।’ বললেন, কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কপালের কী ফ্যার! তার দুঃখের ভার খানিকটা মেয়ের ওপরও পড়লো। সন্তান জন্মের পরপরই মেয়ের স্বামীও মারা যায়। আমোদিনী বলেন, এক মাত্র মেয়ে ছাড়া এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই-না ভাই-বোন, না বাবা-মা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমোদিনী আবারও বলে ওঠেন, ‘আমার দুঃখের সীমা নেই বাবা…।’
জীবনের সমাপ্তিকে আলিঙ্গনের প্রস্তুতি নিতে থাকা সবহারা সংগ্রামী নারী আমোদিনী কী মা-বাবার দেয়া নামকে অর্থবহ করতে পেরেছেন, নাকি দুঃখের ভেলায় সওয়ার হয়ে আজো ভেসে বেড়াচ্ছেন সবার চোখের সামনে? সে উত্তর না হয় এবার আমরাই খুঁজি?