বৃহস্পতিবার, 28 মার্চ, 2024

উত্তাল সাগর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন বাঁচানোই যার ব্রত

ভূমধ্যসাগরে ডুবতে থাকা ২০০ জনেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থীর জীবন বাঁচিয়েছেন অ্যাম্বার শিসগ্রিন নামের একজন উদ্ধারকর্মী

উত্তাল সমুদ্রে কীভাবে ডানা ঝাপটিয়ে ছুটে বেড়াতে হয়, তা বেশ ভালো করেই জানেন অভিজ্ঞ অনুসন্ধানকারী ও উদ্ধারকর্মী অ্যাম্বার শিসগ্রিন। অ্যাম্বার শিসগ্রিন এমন একজন আলোকদিশারী নারী, যিনি সাগরে ডুবতে থাকা অসংখ্য আশ্রয়প্রার্থীর জীবন বাঁচাতে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত, যা সর্বত্রই মুগ্ধতা ছড়িয়েছে, কুড়িয়েছে সম্মান আর প্রশংসা। সাগরে ডুবতে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের জীবন বাঁচানোই ব্রত অ্যাম্বার শিসগ্রিনের।

সম্প্রতি মধ্য ভূমধ্যসাগরে অ্যাম্বার যে মিশনটিতে অংশ নিয়েছিলেন, তা ছিলো অন্যান্য মিশনগুলির তুলনায় কঠিন ও ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও পিছপা হননি শিসগ্রিন। তিনি বলেন, ‘যে মানুষগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নেয়, তাদের জীবন কেমন হওয়া উচিত, তা আমি কল্পনাও করতে পারি না’।

গতবছরের শেষের দিকে অ্যাম্বার স্বেছাসেবকদের নিয়ে গঠিত একটি ‘রিফিউজি রেসকিউ’-এর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তার মতে, ‘এই ঝুঁকি নেওয়াটা অনেক সময় খুব নৃশংস এবং ভয়ঙ্কর হতে পারে’।

আরো পড়ুন

তিন মাইল সাঁতরে শরণার্থীদের জন্য যা করলো এই শিশু…

মানুষ সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, সুদান, সোমালিয়া এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করছে। এত এত যুদ্ধ, নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার পর, কেউ কেউ এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠে যে, পালাবার জন্য তারা চোরাকারবারীদের অর্থ প্রদান করতেও দ্বিধাবোধ করে না-বলে মনে করেন শিসগ্রিন।

বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা বলছে, ২০১৫ সাল মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় পথ দিয়ে ইউরোপে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা আগের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তারা আরও জানায়, একই বছর ইউরোপীয় সরকারগুলি নৌকায় করে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের যে পরিমাণ সহায়তা দিয়েছিলো, তা ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছিলো। যার ফলে শরণার্থীদের যাত্রা আরো বিপজ্জনক হতে শুরু করে।

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে শিসগ্রিন বলছেন, তিনি যেসব শরণার্থীদের সাহায্য করেছিলেন, তাদের শুধু পোশাকটাই অবশিষ্ট ছিলো। কারো কারো কাছে জুতা ছিলো না। আবার কারো কাছে কোনো লাইফ জ্যাকেটও ছিল না। কথাগুলো বলার সময় ৩৬ বছর বয়সী শিসগ্রিন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। শিসগ্রিন এবং তার দল চারটি জাহাজের কাছে পৌঁছে প্রথমে তাদের শান্ত হতে বলে এবং প্রত্যেককে একটি করে লাইফ জ্যাকেট দেন।

তিনি একজন মহিলাকে ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এছাড়া এমন একজন ব্যক্তিকেও তিনি উদ্ধার করেন, যিনি গুরুতর কাঁধের ব্যথায় ছটফট করছিলেন। শিসগ্রিন বলেন, ‘উদ্ধার কাজ করা শারীরিক এবং মানসিকভাবে কঠিন। কিন্তু দুই দিনের বিরতীহীন প্রচেষ্টার পরে আমরা ২২৩জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ জাহাজে স্থানান্তর করতে সক্ষম হই। এদের মধ্যে আটজন শিশুও ছিলো।’

উদ্বাস্তুদের উদ্ধার কাজের জন্য গঠিত আয়ারল্যান্ডভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ২০১৫ সালে সমুদ্রে যেসব আশ্রয়প্রার্থী মারা গিয়েছিলো, তাদের পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া ছিলো, তা জানতে কাজ করেছিল।

সংস্থাটির অনুমান ২০১৪ সাল থেকে মধ্য ভূমধ্যসাগরে ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে। মধ্য ভূমধ্যসাগরে চলাচলের জন্য নৌকাগুলি পর্যাপ্ত মজবুত না হওয়ার কারণে ভ্রমণ অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে যায়।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের বিশেষ দূত ভিনসেট কোচেটেল বলছেন, ‘এই ধরনের বিপজ্জনক যাত্রায় কারো জীবনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়’।

সাহায্য করার মানসিকতা

শিসগ্রিন বলেন, তিনি বিসি-তে অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে এক দশক ধরে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে করতে বিদেশে শরণার্থীদের সাহায্য করার টান অনুভব করেছিলেন। তিনি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বড় হয়েছেন। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া এবং কাজের জন্য উত্তর বিসি’র উপকূলীয় শহর প্রিন্স রুপার্ট থেকে ১০ মিনিট দূরত্বে পথ নৌকায় যেতে হতো। যার ফলে অল্প বয়স থেকেই পানির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।

আবার সমুদ্র কতোটা অস্থির হতে পারে, সেটাও তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন পানির উপর বাস করবেন, তখন ঝড় দেখতে পাবেন’।
হাইস্কুলে থাকা অবস্থায় এক নৌকা দুর্ঘটনায় তার কয়েকজন সহপাঠী মারা গিয়েছিল। আর এই স্মৃতিটি ২৫ বছর পরও তাকে অনুরণিত করে। এই মর্মান্তিক গল্পগুলিই তাকে স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজে আগ্রহী করে তোলে।

আরো পড়ুন

অভিবাসন প্রত্যাশীদের খাদ্য সহায়তা দিলেন  পোলিশ মুসলিম নেতা

আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা কম!

শিসগ্রিন বলেন, আশ্রয়প্রার্থীদের নিরাপদ বন্দর দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তৎপরতার অভাব রয়েছে। এর প্রকৃত উদাহরণ হলো কার্গো জাহাজ। এতে করে জেলে বা সমুদ্রে থাকা অভিবাসীদের উদ্ধার বিলম্ব হয়। শিসগ্রিনের অভিজ্ঞতা, এই ধরনের মিশনের ক্ষেত্রে যখন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, তখন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কীভাবে খাদ্য, জল এবং ওষুধ রেশন পৌঁছে দেওয়া যায় সেই কৌশল খুঁজতে শুরু করা উচিৎ।

আশ্রয়প্রার্থীদের শান্ত রাখতে পারাটা খুব জরুরী। তা না হলে সমুদ্রে যে উদ্বেগময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটার সমাধান করা বেশ কঠিন হতে পারে। ‘আমরা চাই না কেউ ওভারবোর্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ুক। কারণ তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে’, বলে জানান শিসগ্রিন।

একটি নতুন জীবনের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ

সিসিলির উপকূলে বেশ কিছু দিন থাকার পর, ইতালীয় কর্মকর্তারা অবশেষে নিরাপদ আশ্রয়ের অনুরোধ মঞ্জুর করে। যেনো উদ্বাস্তুরা জাহাজটি ছেড়ে দিতে পারে।
শিসগ্রিন বলেন, ‘তাদের (উদ্ধারকৃত আশ্রয়প্রার্থী) বিদায় জানানোর সময় আমাদের মধ্যে আনন্দের অশ্রু ছিলো, হাসি ছিল। আমাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে, যারা এখনো এই বিষয়টা ভেবে কষ্ট পায় এবং উদাসীন হয়ে যায়। এটি অবশ্যই আবেগপূর্ণ এবং স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ছিলো।

সেই মুহূর্তে উত্তেজনা এবং নৌকায় থাকা লোকগুলোর নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ ছিল বৈকি, কিন্তু অনিশ্চয়তাও ছিলো। কারণ তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছিলো এক প্রকার আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। ফলে ‘আমরা জানি না পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে চলেছে’-বলেছেন শিসগ্রিন। তিনি আরো বলেন, ‘যদিও এটি একেবারে একটি নতুন জীবনের সূচনা, তারপরও আমরা জানি না আগামীতে আমাদের হাসতে হবে নাকি কাঁদতে হবে। সবাইকে একটি ভালো ভবিষ্যতের প্রত্যাশা জানিয়ে আমরা তাদের বিদায় এবং শুভকামনা জানিয়েছিলাম’।

সূত্র: কানাডীয় সংবাদ মাধ্যম সিবিসি

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
97SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা