প্রত্যেকটি মানুষের স্বপ্ন থাকে সুন্দর একটা জীবন যাপনের। যে জীবনের সঙ্গী হবে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান আর ভাই-বোন। আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে প্রিয় এই মানুষগুলোর মুখে খুশি ফোঁটাতে পারার মধ্যেই যে প্রকৃত সুখ লুকিয়ে থাকে! এই কথাগুলো সবসময় আমার মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতো। যেহেতু পরিবারের বড় সন্তান সেহেতু আমার ওপর একটু বাড়তি দায়িত্ব থাকাটাও স্বাভাবিক। তাই ভাবতাম, কীভাবে ভালো রোজগার করা যায়, কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।
ঠিক এরকম একটা মুহূর্তে আমার ওমান প্রবাসী চাচা আমাকে ওমানে চলে আসার কথা বলেন। জানান, ওখানে অনেক ভালো চাকরি আছে, ভালো বেতন আছে। আমি নাকি সহজেই আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো। চাচার বলা কথাগুলোকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে থাকি, তাড়িতবোধ করি বিদেশ চলে যাবার। মনে হতো থাকে, সত্যিই আমি অনেক বেশি টাকাপয়সা রোজগার করতে পারবো!
আবার এও ভাবি, আমি তো কখনো নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জ ছেড়ে বাইরে থাকিনি। কখনো বাইরে কাজ করিনি। সেই আমি কি অচেনা-অজানা বিদেশ-আইসা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো? এরকম শত প্রশ্নের দোলাচল আমার দিকে আসতে থাকে। কিন্তু একমাত্র চাচার কথাকে বিশ্বাস করে, তার কথাকে সত্য মনে করে ওমানে পাড়ি দেবার সিদ্ধান্ত নিই শেষমেষ।
বিদেশ যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু হাতে যে টাকা পয়সা নেই। শুরু করলাম ধারদেনা। দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করে চাচার নির্দেশনা মেনে ওমান চলে আসার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
আরো পড়ুন: ‘আমার লক্ষ্য এখন ইউরোপ যাওয়ার এবং তা বৈধভাবেই’
প্রিয়জনদের ফেলে দুচোখভরা অশ্র নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে আসার দিনটির কথা এখনো মনে আছে। তারিখটি ছিলো ১১ এপ্রিল ২০১৫। ওমান এসে চাচার কাছেই উঠি। ওনার কাছেই থাকতাম, উনি খাওয়াতেন। মোটামুটি খুব সুন্দরভাবেই দিনগুলো কাটতে থাকে আমার। অবস্থা এমনও হয়েছিলো যে, ভুলেই গিয়েছিলাম, লাখ লাখ টাকা ধার করে এই বিদেশে এসেছি।
আমি চাচাকে বলি আমাকে কাজ দেন, একটা কাজ দেন। চাচা কথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেন, অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। উনি মূলত ডলার কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। আমাকে দিয়ে টুকটাক কাজ করাতেন। প্রথম একবছর আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
পরে দেখি, অন্য কোনো কাজে আমাকে না দেয়ার মূল কারণ ওনার স্বার্থ। অনুধাবন করি, উনি আমাকে এত স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশ এনেছেন, শুধু ওনার স্বার্থ হাছিলের জন্যই। উনি চেয়েছিলেন কম বেতনে আমাকে দিয়ে তার ব্যবসা দেখভাল করাবেন। আর উনি দেশে আসা যাওয়া করবেন।
বেশ কিছুদিন কাজ করার পরও সে অর্থে বেতনাদি না পাওয়ার পর হতাশ হতে থাকি। তাকে আবার বলি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। উনি বারবার একই কথা বলেন, ‘চাকরি করলে আর কয় টাকা পাবা। এখানে তুমি বেশি রোজগার করবা, তোমার ঋণ পরিশোধ করবো।’ এরকম আরো নানা প্রলোভন।
টাকার কথা বলতেই উনি বলতেন, দেশ থেকে আসার পর ব্যবস্থা করে দেবো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও সেই মোহের ফাঁদে পড়ে যাই, তাকে বিশ্বাস করে কাজ চালিয়ে যাই। কিন্তু দিনশেষে উনি কোনো টাকাই দেন না। একপর্যায়ে টিকতে না পেরে চাচার কাছ থেকে চলে আসি।
শুরু হয় নতুন অচেনা আরেক যুদ্ধ। যোগ দিই ঔষুধ কোম্পানিতে। এখানে দেড় বছর কাজ করি। মাসে ১৫০ রিয়াল রোজগার হতো। এতকিছুর পরও সরল মনে ওই টাকা চাচাকে দিতাম বাড়ি পাঠানোর জন্য। কিন্তু তিনি সেখান থেকেও টাকা মেরে দিতেন। পরিস্থিতিগত কারণে ঔষুধ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিই।
মুখোমুখি হই আরেক লড়াইয়ের। বাধ্য হয়ে উত্তপ্ত মরুভূমির ভেতর একটি মুদির দোকানে কাজ নিই। দোকানটি ছিলো কুমিল্লার এক লোকের। এখানে মাসিক ১০০ রিয়াল বেতন পেতাম। এখানে যে খাবার দেয়া হতো, তা মনে পড়লে আজো বুকটা ভেঙে যায়। প্রতিদিন প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঁচা শাক, শব্জি আর কখনো কখনো ডিম দিয়ে বলা হতো, ‘‘এই নাও এগুলো নিয়ে নিজে রান্না করে খাও।’’
মাত্র ১০০ রিয়াল বেতন দিলেও আমাকে নিজের বাসা ভাড়া করে থাকতে হতো। আমার এতদিন পরও মনে হয়, ওমানে আসার পর যত জায়গায় কাজ করেছি, তার মধ্যে এই মুদির দোকানেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছি। কষ্ট সহ্য না করতে পেরে বাধ্য হয়ে এখানে ইস্তফা দিই।
এরপর রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করার প্রস্তাব পাই। যদিও আমার এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা ছিলো না কিন্তু এখানে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পাই। কাজ না জানা স্বত্বেও তারা আমাকে ৭০ রিয়াল বেতন দিতো। এটা দিয়ে কোনোমতে থাকা-খাওয়ার সংস্থান করি। একবছরের মতো এখানে কাজ করি, কাজ শিখি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটিও বন্ধ হয়ে যায়।
আরো পড়ুন: ‘বৈসাবি উৎসব আমাদের কাছে ঈদ আর বড়দিনের মতো’
এখন আমি মাস্কেট থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মোবালায় একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করি। বেতন পাই ২০০ রিয়ালের মতো। যা দিয়ে মোটামুটি ভালো আছি। বিদেশে এসে কষ্ট করে একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছি। স্বপ্ন এখনো হাতছাড়া করিনি। প্রায় আট বছর হতে চললো ওমান এসেছি। কিন্তু তবুও চেষ্টা করছি, ধীরে ধীরে এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে। কারণ এখন এখানে অন্তত কাজের সম্মান পাই, মানুষের ভালোবাসা পাই। এখন নিজের মতো করে চলতে পারি।
তবে একটি লোককে কখনো অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারবো না, তিনি হলেন আমার সেই চাচা, যিনি আমাকে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে এই দেশে নিয়ে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন। প্রবাসে আমার এই চাচাই সবচেয়ে বড় খলনায়ক। আমি তাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। তার স্বার্থপরতার কারণেই দেশে থাকা আমার পরিবার চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছিলো আর আমি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম।
আত্মকথন: সজীব আহমেদ সাজী, ওমানপ্রবাসী মটর মেকানিক।
সজীব আহমেদ সাজী’র এ আত্মকথনটি সংগ্রহ ও অনুলিখন করেছেন মোহাম্মদ সোহেল, ওমানপ্রবাসী।