‘‘আসার সময় একটা কথাই শুধু বলে আসতে পেরেছিলাম মালিককে, ‘রোজ কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনার বিচার করবে।’’
যে মানুষটি পরিবারের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে ঘরছাড়া জীবনকে বেছে নেয়, স্ত্রী-সন্তানের মুখটুকু দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে, সেই মানুষটিরও স্বপ্ন থাকে-একদিন ‘সবকিছু ঠিক’ হয়ে গেলে, নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে আনন্দ-হাসিতে বাকি জীবনটা পাড় করে দেবে। কিন্তু সবার জীবনে কি ‘সবকিছু ঠিক’ হয় কখনো?
হয়তো না। যদি হতো, তাহলে কেনো ২২ বছর পরও সোদি আরব ফেরত মো. জাকির হোসেন এখনো প্রিয়জনদের কাছে ফিরতে পারছেন না, কেনো গ্রামে থাকা পরিবারের কাছে না গিয়ে এখনো সন্ধ্যা নামলে বদ্ধ ঘরে একাকি দিনযাপন করতে হয় তাকে?
প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯৯ সালের দিকে। পিরোজপুর জেলার বাসিন্দা মো. জাকির হোসেন অনুভব করতে থাকেন, বিদেশে যেতে পারলে তার সংসারের অভাব অনেকটা দূর হয়ে যাবে, শেষ বয়সটা আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারবেন। কথার ফাঁকে জাকির হোসেনকে প্রশ্ন করা হলো, বিদেশে গেলে এত কিছু মিলবে, এমনটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? জাকির উত্তর দেন, ‘আমার গ্রামের লোকজনের মধ্যে যারা বিদেশে গেছে, অধিকাংশকেই দেখেছিলাম, অনেক বেশি টাকা আয় করে তারা। তাদের পাঠানো টাকা দিয়ে স্ব স্ব পরিবার পরিজন অনেক সুখে শান্তিতে চলাফেরা করতো। এটা দেখে আমার মনের মধ্যেও স্বপ্ন উঁকি দিতে থাকে যে, যদি বিদেশে যেতে পারি, তাহলে আমার পরিবারও অনেক বেশি সুখে থাকবে। মূলত সংসারের প্রিয় মুখগুলোর কথা চিন্তা করেই বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিই।’
আরো পড়ুন: পরিবারের অনটনের কাছে আমার স্বপ্নকে সঁপে দিতে হয়েছে
২০০০ সালে দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যাওয়ার বন্দোবস্ত হয় জাকির হোসেনের। কৃষি ভিসায় ভালো চাকরির আশ্বাসে দালালের হাতে সবমিলিয়ে ১০ লাখ টাকা তুলে দেন তিনি। জানালেন, এই টাকার পুরোটাই তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার করেছিলেন।
বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে সৌদি আরবে পা রাখেন লেখাপড়া না জানা জনাব জাকির হোসেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন চুরমার হতে সময় নেয়নি এতটুকু। শুরুতেই ধাক্কা খান এটা শুনে যে, কৃষি ভিসার কথা বলা হলেও মূলত তাকে পাঠানো হয়েছে ভ্রমন ভিসায়। এরপর তাকে উট চড়ানোর একটি কাজ দেয়া হয়। দিনে আট ঘণ্টা কাজ ও খাওয়া-দাওয়াসহ প্রতি মাসে ৫০০ রিয়াল বেতনের শর্তে কাজ শুরু করেন তিনি।
কিন্তু বিধি বাম, জাকির হোসেনকে প্রথম দিন থেকেই ভোর চারটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত টানা কাজ করতে হয়। জানান, অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম পর্যন্ত মেলেনি তার। দুঃসহ সেই দিনগুলোর কথা ভেবে চোখ ভিজে আসে জাকির হোসেনের। সন্ধ্যাবাতির স্পর্শে চিকচিক করতে থাকে তার সেই অঝোরধারা। ‘এমনও দিন গেছে, দুপুরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজ করার পর শরীরটা যখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না, তখন অনুনয় বিনয় করে এক ঘণ্টার বিশ্রাম চেয়েছি। কিন্তু মালিকপক্ষের মন এতটুকু গলেনি, উল্টো মারধর করেছে।’
এভাবে দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করে কাজ করতে থাকেন জাকির হোসেন। ছুটিতো মেলেনি, সেইসঙ্গে জোটেনি ঠিকমতো তিনবেলার খাবার, শুকনো রুটি খেয়ে পার করে দিয়েছেন দিনের পর দিন। জাকির হোসেনের কাছে সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার হলো, এত কষ্ট করার পরও মাস শেষে তাকে বেতন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। চাইতে গেলে বলা হতো একসঙ্গে দিবে।
আরো পড়ুন: জীবন নিয়ে এক বিরাট বাজিই ধরেছিলাম
ছয় মাস টানা কাজ করার পর একদিন কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায় জনাব জাকির হোসেনের; সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসার। কিন্তু দেশে যে ফিরবেন, সেই টাকাও যে নেই জাকির হোসেনের। উপায় না পেয়ে উটের খামারের মালিকের কাছে কাকুতি মিনতি করেন তাকে একটি বিমানের টিকিট কিনে দেয়ার। শেষপর্যন্ত অনেক কষ্টের পর রাজি করাতে সক্ষম হন তিনি, পেয়ে যান দেশে ফেরার টিকিট। জাকির হোসেন বলেন, ‘‘আসার সময় একটা কথাই শুধু বলে আসতে পেরেছিলাম মালিককে, ‘রোজ কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনার বিচার করবে।’’
দেশে ফেরেন জাকির হোসেন, অতঃপর
শুন্য হাতে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে দেশে ফেরেন জাকির হোসেন। যদিও তার সে যন্ত্রণার ভার আরো বেড়ে গিয়েছিলো পাওনাদারদের চাপে। বিদেশ যাওয়ার সময় যে দশ লাখ টাকা তিনি ধার করেছিলেন, সেই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য একের পর চাপ আসতে থাকে তার ওপর। প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়া মানুষটি যেন আরো দিশা হারিয়ে ফেলেন। কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে রোজগারের উদ্দেশ্যে খুলনা শহরে চলে আসেন তিনি।
একাকি নিঃসঙ্গ নতুন জীবনের শুরু
খুলনায় এসে ভ্যানগাড়িতে করে ভ্রামমান দোকান চালু করেন জাকির হোসেন। আইটেম বলতে কাঁচা মরিচ আর লেবু-এগুলো বিক্রি করেই সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে এ পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন তিনি। নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও টানা ২১ বছর ধরে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখান থেকে রোজগারের টাকা দিয়েই দুই ছেলে, তিন মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন তিনি। সন্তান-পরিবারের খরচ সবই তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী দিয়ে যাচ্ছেন। দুই-তিন মাস পরপর সুযোগ পেলে কয়েকটা দিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আসেন গ্রাম থেকে।
জনাব জাকির হোসেন খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গার যে ছোট্ট বাসাটিতে থাকেন, সেটি তাকে দিয়েছেন ব্যবসায়ী আশরাফ আলী হাওলাদার। মূলত যে টাকা জাকির হোসেন রোজগার করেন, তা দিয়ে হোটেলে তিনবেলা খেয়ে, ঘর ভাড়া দিয়ে বাড়িতে পাঠানো কষ্টকর হয়ে যায়। একারণে ঘরভাড়া টাকা যাতে সঞ্চয় করতে পারেন, এ ভাবনা থেকে জনাব আশরাফ আলী হাওলাদার তাকে থাকার এ ব্যবস্থাটি করে দিয়েছেন।
আরো পড়ুন: যা আশা করেছিলাম জীবন এখানে মোটেও সেরকম ছিল না
জাকির হোসেন কাজ শেষে করে যখন বাসায় ফিরে আসেন তখন সন্ধ্যা নামে। প্রতিদিনই তাকে দেখা যায়, সুতো কাটা ঘুড়ির মতো এদিক সেদিক একাকি ঘুরে বেড়াতে কিংবা নিঃসঙ্গ অবস্থায় শুয়ে বসে থাকতে। পরিবার পরিজন ছাড়া দিনের পর দিন তার এই একাকি জীবনযাপন দেখলে যেকারোরই আঁতকে ওঠার কথা।
কিন্তু জীবনের ফেরে পড়ে সব হারানো বিদেশফেরত এই মানুষটি এসব কিছুকেই মেনে নিয়েছেন স্বাভাবিকভাবে।
উল্টো এতকিছুর পরও স্বপ্ন দেখেন, সুযোগ পেলে আবার বিদেশ যাবার! তাহলে পরিবার? ‘আমার কাছে তো দেশ আর বিদেশ একই কথা ভাই, দেশে থেকেও তো পরিবারের কাছে থাকতে পারি না, বাচ্চাদের লাভ কী বলেন!’ দীর্ঘ সময় ধরে আলাপের পর জানালেন, এশার নামাজের সময় চলে যাচ্ছে, এরপর কোনো কথা না বাড়িয়ে জাকির হোসেন ছুটলেন মসজিদের পানে…