মোহাম্মদ সোহেল
শুরুর গল্প মিষ্ট নয়
অন্য অনেক শিশুর চেয়ে আমার শৈশবের গল্প ছিলো ভিন্ন। অন্য অনেক কিশোরের চেয়ে আমার কৈশোরের ফারাক ছিলো ভীষণ। একটি শিশুর যখন ছোটো ছোটো পায়ে বাড়ির উঠানজুড়ে ছন্দে ছন্দে হেঁটে বেড়ানোর কথা, তখন আমাকে দেনাগ্রস্থে মলিন হয়ে যাওয়া বাবার কাঁধে চড়ে জন্মভিটা ছাড়তে হয়েছে। যে কিশোরবেলায় মাঠ-প্রান্তরজুড়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়ানোর কথা, তখন আমাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে, হয়েছে হোটেলের ক্যান্টিন বয়ের পরিচয় বহন করতে। বলা যেতে পারে, শিশুশ্রম আইনের কোনো প্রয়োগ আমার বেলায় ঘটেনি। এই ফাঁকে আমিও শ্রম দিয়ে গেছি দেদারছে–শুধু বেঁচে থাকার তাড়নায়।
বিদেশপাড়ি
আমার মামা ওমান থাকেন–কথাটি জানতাম। একদিন আমার পরিবার থেকে বলা হলো, আমাকে নাকি বিদেশ নিয়ে যেতে চান মামা। পরিবারের সবাই রাজি। কিন্তু আমার মন মানে না। আসলে মা, বাবা আর দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছা কোনোটিই আমার ছিলো না। ছোটো থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, যেভাবেই হোক নিজেকে দেশের মাটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও আমার এ ইচ্ছার কোনো মূল্য থাকে না। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওমান যাবার।
জমানো কিছু টাকা, ধারদেনা–সবমিলিয়ে আমাকে ‘কফি শপ’-এ কাজের ভিসা দিয়ে ওমান পাঠিয়ে দেয়া ২০১৮ সালে। কথা ছিলো এখানে পৌঁছানো মাত্রই কাজ শুরু করবো, বেতন পাবো। কিন্তু তা হলো না। প্রথম ছয় মাস কোনো কাজই করতে পারিনি। মামাই দেখভাল করেছেন আমাকে। আসলে যে কফি শপে আমার কাজ করার কথা, সেই শপের মালিক দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় তিনি আসতে পারেননি, আর আমারও কাজে যোগ দেয়া হয়নি। পরে উনি এসে আমাকে কাজে নেন।
বিদেশ থাকার প্রথম অভিজ্ঞতা

ওমানের রাজধানী মাস্কট থেকে ১৮৩ কি.মি. দূরের শহর ইব্রা’য় আমার বসবাস। সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে এসে শুরুতে খুব খারাপ লাগতো, পরিবারকে মিস করতাম। মরুভ‚মির পরিবেশ, প্রচণ্ড গরম। ওখানকার মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে, যা আমি জানতাম না। শুরুতে যেহেতু ছয় মাস বসে থাকতে হয়েছিলো, তখন আমাকে রাজমিস্ত্রীর কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু আমি বলেছিলাম, যে ভিসায় এসেছি সেই কাজই করবো। ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর লড়াই করি এবং একটা পর্যায়ে উতরে যাই।
ওমানের একটি বিষয় আমার খুব ভালো লাগে, এখানকার স্থানীয় মানুষজন, পুলিশ, সরকার সবাই সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করে। সবাই সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলে। যতদূর দেখেছি, এখানকার মানুষ বাংলাদেশিদের ভালোই জানে। কিন্তু এরা যখন অন্যদের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলে, হাতাহাতি করে তখন এখাকার মানুষজন তা অপছন্দ করে।
চুক্তি শুধু কাগজ কলমে
চুক্তি অনুযায়ী, বিগত ছয় মাসের বেতন দেয়ার কথা থাকলেও চার মাসেরটা পেয়েছি। দুই মাসের বেতন কেনো দেয়া হয়নি, তার ব্যাখ্যা পাইনি। আবার চুক্তি অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা থাকলেও আমাকে দেয়া হতো ১৭ হাজার টাকা। বছর শেষে বেতন বাড়ানোর কথা থাকলেও কোনো বেতন বাড়েনি। কর্মঘণ্টার বালাই নেই। কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে দুপুর একটা, আবার বেলা তিনটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতাম। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ ঘণ্টা ডিউটি করা লাগে। কিন্তু ওভারটাইমের বিপরীতে কোনো মজুরী নেই।
বর্তমানে একই মালিকের অন্য আরেকটি হাউজহোল্ডস প্লাস্টিকের দোকানের সেলসম্যানের দায়িত্ব পালন করি। এখানেও সকাল ৮টা থেকে দুপুর দুইটা আবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পরিশ্রম করি। অনেক অনুরোধ, কাকুতি মিনতির পর সম্প্রতি বেতন তিন হাজার টাকা বাড়িয়েছে। তবে মালিকপক্ষ খাওয়া খরচ দেয়। নিয়ম অনুযায়ী ২ বছর পরপর ৩ মাসের ছুটি দেয়, আসা-যাওয়ার খরচসহ।
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ঝোক কেনো বাংলাদেশি শ্রমিকদের দিকে
এই কয়েক বছরে আমার অভিজ্ঞতা হলো ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী। অবাক করার বিষয় হলো, তাদের নিজেদের দেশের শ্রমিকদের তারা খুব একটা কাজে নেয় না। এর প্রধান কারণ তারা কম টাকায় আমাদের শ্রম কিনতে পারে। ইচ্ছে মতো খাটাতে পারে। যা ওদের দেশের শ্রমিকদের দিয়ে পারে না। ভারতীয় শ্রমিকরা বেশি অর্থ দাবি করে, কর্মক্ষেত্রে তারা কোনো সমস্যায় পড়লে তা সমাধানের জন্য তাদের পথ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা তথা বাংলাদেশের শ্রমিকরা এসবের কোনো সুবিধাই পাই না।
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি!

এমনিতেই কর্মক্ষেত্র, বেতনাদি নিয়ে আমার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শেষবারের মতো দেশ থেকে ঘুরে আসার পরই আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। বলা হয়, আমি নাকি ব্যবসায়ের টাকা হাতিয়েছি। যা ছিলো পুরোটাই বানোয়াট। বুঝতে পারি ওরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু আমি যেহেতু সৎ ছিলাম, তাই বিচলিত হইনি। এরপর আমি নিজে আবার হিসাব করি, দেখি আমি ঠিক আছি, ওরাই ভুল করেছিলো। এরপর ওরা আর বেশিদূর এগোয়নি।
স্বপ্নপূরণ…
২০১৮ সালের জুন মাসে ওমান আসার পর থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু রোজগার করেছি, তা দিয়ে হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি। কিন্তু বিদেশে এসে যতটুকু স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি। আমার বাবা দোকানের ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক টাকার ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আমি সেই টাকা পরিশোধ করেছি। তাকে দেনামুক্ত করেছি। ছোটো থাকতে চোখের সামনে দেখেছি, আমার বাবার সরলতার সুযোগ নিয়ে আত্মীয়স্বজনরা আমাদের জমি হাতিয়ে নিয়েছে। এরপর আমাদের তেমন কোনো জমি ছিলো না। তাই আমি গ্রামে তিন-চার লাখ টাকার জমি কিনেছি। আমার ছোটো বোনের বিয়ে দিয়েছি।
লক্ষ্য এখন ইউরোপ যাওয়ার
ওমানের অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অনেকেই দেশটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যারাওবা আছে, তারাও কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছে। তেমন কোনো কাজকর্ম নেই। মূলত করোনার পর থেকে অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছে। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে তারা প্রত্যাশিত বেতন বাড়াচ্ছে না। কিন্তু আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ওদিকে পরিশ্রমের মাত্রাও বাড়ছে।

এখন নিজেকে নিয়ে তাই নতুন করে ভাবছি। জীবনটাকে নতুনভাবে সাজাতে চাইছি। একারণে এখন আমি ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। এখানে কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরবো আগামী বছর। এরপর সেখান থেকে ইউরোপে আসার চেষ্টা করবো। তবে অবশ্যই বৈধভাবে আসবো। যতদূর জানি, যারা বৈধ পথে ইউরোপের দেশগুলোতে আসে তাদের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত, বেতন বেশি।
সবমিলিয়ে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারবো। আসলে দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পড়ে আছি শুধু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশায়। এ লক্ষ্য যে আমাকে অর্জন করতেই হবে।
লেখক: ওমান প্রবাসী বাংলাদেশি