শুক্রবার, 1 নভেম্বর, 2024

ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর অভিবাসী ফুটবলাররা…

সাহারা মরুভূমির বিকালের আভায় জমতে শুরু করেছে তপ্ত রোদ। গেল মঙ্গলবার নাইজারের একটি ফুটবল দলের খেলোয়াররা অনুশীলনে ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রচণ্ড প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে দৌড়ঝাপ করার কারণে তাদের চেহারার মধ্যে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। তা স্বত্বেও তাদের চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশে টইটুম্বুর।

নাইজারসহ পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে আগত অধিকাংশ এই তরুণ খেলোয়ারদের একটাই স্বপ্ন কোনো একদিন তারা ইউরোপে গিয়ে খেলবেন। এদের মধ্যে এমনও খেলোয়ার রয়েছেন, যারা কিনা তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নাইজারের আগাদেজের এসি নাসারা ফুটবল দলে ছুঁটে এসেছেন। মূলত আগাদেজকে গোপনে ইউরোপে প্রবেশের অন্যতম প্রধান রুট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

‘সুনির্দিষ্টভাবে এই দলে খেলার জন্য আমরা এসেছি, এছাড়া কিছু রোজগার করার জন্যও, তবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ইউরোপে যাওয়া’-বলেন লাইবেরিয়া থেকে বাসে চড়ে আগাদেজে আসা সলোমন ওরিয়নওন। ‘এই মৌসুমের শেষের দিকে এটাই আমার পরিকল্পনা। লিবিয়া যাওয়া অথবা ওখান থেকে মরোক্কা।’

সলোমন ওরিয়নওন অন্যান্য আরো হাজার হাজার অভিবাসী খেলোয়ারদের মতো অপেক্ষায় আছেন ইউরোপে প্রবেশের। ‘আমি অনেক গরীব একটি পরিবার থেকে এসেছি। তাই আমি যদি ইউরোপ যেতে পারি, এটা আমার পরিবারের জন্য উপকার হবে’-বলেন ওরিয়নওন।

আরো পড়ুন: ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত অভিবাসীদের জন্য তৈরি হচ্ছে স্মৃতির সাউন্ডট্র্যাক

অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বৈধ ব্যবসা!
কয়েক বছর ধরে ইউরোপে ঢোকার জন্য আন্তঃমহাদেশিয় অভিবাসনের রুট হিসেবে আগাদেজ অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আগাদেজ একসময় চোরাকারবারীদেও স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিলো। আর এখন এখানে বিভিন্ন ফুটবল টিম গড়ে উঠেছে, যারা অভিবাসীদের ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলে এবং এর মাধ্যমেই অভিবাসীদের ইউরোপে ঢোকানোর চেষ্টা করে।

সাহারার শেষ বড় শহর এই আগাদেজ থেকে অভিবাসীদের ট্র্যাকে উঠিয়ে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। অন্যান্য ক্লাবের মতো নাইজারের টোয়েন্টি-টিম ন্যাশনাল লিগে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি খেলোয়ার রয়েছেন। কিন্তু নাসারার অবস্থান সুবিধাজনক হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে এটিই বেশি জনপ্রিয় রুট।

ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বাচির আম্মা, একসময় ছিলেন চোরাকারবারী। তিনি জানিয়েছেন, পুরো আফ্রিকা থেকে অভিবাসী আসে, যারা কিনা ইউরোপে ফুটবল খেলতে আগ্রহী। যাদের যথেষ্ট প্রতিভা আছে, তাদের নাসারায় যুক্ত হওয়ার জন্য স্বাগত জানানো হয়েছিলো, এবং তাদের ইউরোপে যাত্রার আগে আগাদেজে খেলা এবং অর্থ উপার্জন করার জন্য একটি মৌসুম কাটানোর জন্য রাখা হয়। ‘এটা দারুণ সুযোগ, ক্লাব এগিয়ে যাচ্ছে। অভিবাসীদের মধ্য থেকে আমরা ভালো খেলোয়ার খুঁজি।’

আম্মা যখন অভিবাসী হিসেবে লিবিয়ায় রওয়ানা দিয়েছিলেন তখন তার একটি অফিস ছিলো। তিনি অন্যান্য চোরকারবারীদের মতো বৈধভাবে ভ্রমণের জন্য টিকিট বিক্রি করতেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবল চাপে নাইজার যখন আগাদেজের উত্তরাঞ্চলে সমস্ত বিদেশিদের চলাচল নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করেছিলো, তখন এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে পরবর্তী বছরগুলোতে আগাদেজের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়ে।

‘এখানে (ক্লাবে) আমার এক বন্ধু খেলতো, যে কিনা এখন মিলানে আছে’-বলেন জোয়ানাহ জ্যাকসন, লাইবেরিয়ান মিডফিল্ডার, যার গভীর স্বপ্ন, একদিন তিনি চেলসিতে খেলবেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি নাইজারে এসেছিলেন পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। তার মাসিক আয় ছিলো ১৯৬ ডলার।

অবশ্য অন্যদের সঙ্গে গা ভাসাননি জ্যাকসন। তিনি সতর্ক যে, তার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ অঞ্চল দিয়ে তাদের সীমান্তে প্রবেশ ঠেকাতে লিবিয়ান কোস্টগার্ডকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। এই বাহিনী ভয়াবহ একটি আটককেন্দ্র পরিচালনা করে। এছাড়া ভ‚মধ্যসাগরের প্রবল ঢেউয়ের দুর্যোগপূর্ণ অবস্থাতো রয়েছেই। সবমিলিয়ে তিনি তাই এই মৌসুমের শেষের দিকে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করবেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

আরো পড়ুন: নরওয়ের দৈত্য দানোর পাহাড়ে, ট্রোলটুংগা সফরগাথা

‘কখনো কখনো আপনাকে সপ্তাহজুড়ে কোনো রকম খাবার, পানি ছাড়া কাটাতে হবে। পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ।…আমি ভালো কিছু করতে চাই, এর ফলে আমার পরিবার উপকৃত হবে। আমি এখন যদি আমার জীবনটাই হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমার শরীরটা আমার পরিবারের কাছে ফেরত যেতেও সময় লাগবে। তারা আমাকে দেখতে যেতে পারবে না, তারা কিছুই জানতে পারবে না। এসব ভেবে আমি কিছুটা শঙ্কিত।’

সবমিলিয়ে আগাদেজে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আনাগোনা কম মানে সেখানকার অর্থনীতিরও নাজুক পরিস্থিতি। স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষই বেকার হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে আগাদেজের ফুটবল ক্লাবগুলো কর্তৃক অভিবাসী ফুটবলারদের ইউরোপের দেশগুলোতে ঢোকানোর আয়োজন বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে।

সূত্র: আলজাজিরা

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা