প্রাণের সঙ্গে নীড়ের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর। নীড় ছাড়া প্রাণ অস্তিত্বশূন্য। মানুষসহ যেসব প্রাণীকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই-তাদের বেলা এ এক প্রমাণিত সত্য। সবাই হয়তো একারণেই সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়, কষ্ট পায় নিজ বাসস্থানের বিনাশ হলে।
টমি নামের একটি কুকুর ছানার বেলায়ও এমনি এক ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এই কুকুর ছানাটির থাকার জন্য একটি জায়গা ছিলো, ছিলো নিজের আঙিনা বলে অন্তত কিছু একটা। যেখানে ও বসবাস করতো, জীবন যাপন করতো। অথচ গত পরশু সেই জায়গাটি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকেই টমি হয়ে পড়েছে দিশেহারা আর অস্থির পাগলপ্রায়। সে কেবলই এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে দিগভ্রান্ত হয়ে, অনবরত খুঁজে ফিরছে তার প্রিয় আবাসস্থলের।

বাস্তুহারা হওয়ার শোক কুকুর ছানাটিকে এমন গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, আগে যেখানে শাবকটি খেলাধুলা করতো লোকজনের সঙ্গে, খুঁনসুঁটিতে মাত হয়ে থাকতো পরিচিতজনদের সঙ্গে, সেখানে এখন ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা ধ্বংসস্তুপের দিকে। কোনো দৌড়ঝাপ নেই ওর, নেই চঞ্চলতার বিন্দুমাত্র প্রকাশ।
আরো পড়ুন: জোরপূর্বক অভিবাসন এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
গত বছরের শেষের দিককার কথা। প্রচণ্ড শীতে সবার জবুথবু অবস্থা। এমনি এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে খুলনার সোনাডাঙ্গা-গল্লামারি সড়কের ঠিক মাঝখানটায় এই কুকুর ছানাটিকে পাওয়া যায়। দ্রুততার সঙ্গে সড়কের মাঝখান থেকে ওকে নিয়ে আসা হয় সদ্য ভেঙে ফেলা এই স্থাপনাটির সামনে। যার ঠিকানা, ৫০ এম এ বারী সড়ক, সোনাডাঙ্গা।
কুকুরছানাটির বয়স তখন আনুমানিক তিন থেকে চারদিন; চোখ ফোঁটেনি, ঠিক মতো উঠে দাঁড়াতে পারে না। এমনকি দুধ দিলেও তা খেতে বেগ পেতে হয় ওর। অবশ্য দিন কয়েকের মধ্যে ও সুস্থ হতে থাকে। আশপাশের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবার আন্তরিকতায় তরতাজা হয়ে ওঠে কুকুর ছানাটি।
একপর্যায়ে বাবু নামের একজন ব্যক্তি, যিনি সদ্য ভেঙে ফেলা স্থাপনাটিতে থাকা গাড়ির গ্যারেজে চাকরি করতেন, তিনি কুকুরছানাটির দেখভালের পুরো দায়িত্ব নেন। উনিই কুকুরছানাটির নাম দেন টমি। ওকে তিনি প্রতি বেলায় যথাসাধ্য ভালো খাবার দিতেন, সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতেন। টমির গলায় পরিচয়সূচক বেল্টও সেঁটে দেন। ধীরে ধীরে রাস্তায় কাতর অবস্থায় পড়ে থাকা কুকুরছানাটি তরতাজা হয়ে ওঠে, খেলাধুলা আর প্রাণোচ্ছাসে সবাইকে মাত করে রাখতে থাকে।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, রাষ্ট্রীয় কাগুজে আইনের পরোক্ষ বলি হয় টমি নামের এই কুকুরছানাটি। ওর বেড়ে ওঠার স্থাপনাটি মূলত খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) নকশা বহির্ভূত। বারবার নোটিস দেয়া স্বত্বেও স্থাপনাটি অপসারণ না করায় কেডিএ তার আইন অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনাটি ভেঙে ফেলে।
আপাতত দৃষ্টিতে স্থাপনাটি ভেঙে উপযুক্ত, ন্যায্য ও আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়েছে, একথা সত্য। কিন্তু টমি নামের যে কুকুর ছানাটি এ জায়গাটিতে বেড়ে উঠেছে, যে জায়গাটিকে ও আপন নিবাস মনে করেছে, সেই জায়গাটির প্রতি ওর কি কোনো অধিকার নেই? প্রাণীর অধিকারের প্রতি মূল্য দিয়ে টমির জন্য কী কোনো বিকল্প আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেই আইনে?
প্রসঙ্গত, পৃথিবীতে আনুমানিক ৮০০ মিলিয়ন কুকুর রয়েছে। যার মধ্যে ৪০ শতাংশই গৃহহীন। সবচেয়ে বেশি গৃহহীন কুকুর রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে, ৬২ মিলিয়ন। বিপরীতে বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লাখ কুকুর রয়েছে। যার মধ্যে ৮৩ শতাংশই গৃহহীন অর্থ্যা পথঘাটে বেড়ে ওঠা। যার বেশিরভাগই অযত্ন-অবহেলা বেড়ে ওঠে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, অভিবাসী ডটকম