সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রী রচিত ও নির্দেশিত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’- নামের একটি লোমহর্ষক ভারতীয় সিনেমা। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরে অনেকেই চলচ্চিত্র পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীকে একই ধাঁচের আরো একটি সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে সিনেমা তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন।
এমনকি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তি পাওয়ার আগেই অগ্নিহোত্রী টুইটারে একটি প্রশ্ন লিখে পোস্ট করেছিলেন তার পরবর্তী তদন্তের বিষয় কী হওয়া উচিত সেটা জিজ্ঞেস করে। সেই প্রশ্নের উত্তরে পাওয়া অনেকগুলো পরামর্শের একটি ছিল মরিচঝাঁপি। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্ত এবং প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যালও টুইটারে অগ্নিহোত্রীকে মারিচঝাপির উপর একটি সিনেমা বানানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন।
মরিচঝাঁপি নামের একটি দ্বীপ থেকে শরণার্থীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা কোন থ্রিলার উপন্যাসকেও হার মানাবে অনায়াসে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের একটি ছোট দ্বীপ মরিচঝাঁপি। কিছু তথ্য অনুসারে, ১৯৭৯ সালের মে মাসে বাম সরকারের আমলে রাজ্য পুলিশ কর্তৃক উচ্ছেদ অভিযানে মহিলা এবং শিশুসহ প্রায় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা এবং ধর্ষণ করা হয়েছিল।

মরিচঝাঁপির এ ঘটনা অবশ্য লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যেত, যদি না জেষ্ঠ্য সাংবাদিক এবং লেখক দীপ হালদার ‘ব্লাড আইল্যান্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করতেন। তার লেখা বইটি জনপ্রিয় হওয়ার পরেই, অগ্নিহোত্রী একটি টুইট বার্তায় বলেছিলেন যে, মরিচঝাঁপির ঘটনাটি একটি গল্পের মতোন, যে গল্পটা অবশ্যই সিনেমায় বলা উচিত।
২০২১ সালের নভেম্বরে, চলচ্চিত্র পরিচালক সংঘমিত্র চৌধুরী এই পরামর্শও দিয়েছিলেন যে, মরিচঝাঁপির কাহিনী ইতিহাস বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তিনি গোয়ার ৫২তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় এই কথা বলেন।
কি হয়েছিলো মরিচঝাঁপিতে ?
ঘটনার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে ভারত বিভাগের সময়টায়। দেশভাগের পর, পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়া হিন্দু উদ্বাস্তুরা দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে যেতে শুরু করেছিলো। শুরুতেই অভিবাসী হয় উচ্চ বর্ণের এবং ধনী হিন্দুরা। তখনো নিম্নবর্ণের মানুষেরা যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল নামের এক বাঙালি দলিত নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের দলিত-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তার আহ্বানে কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে ছিলো। কিন্তু শীঘ্রই হিন্দু দলিতরাও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালাতে শুরু করে।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্থানান্তরের ব্যাপারটা পর্যায়ক্রমে ঘটেছিলো এবং যারা প্রথম দিকে গিয়েছিলো, তারা পশ্চিমবঙ্গে বসতি স্থাপন করতে পেরেছিলো। কিন্তু অভিবাসীদের প্রবাহ ছিলো অব্যাহত এবং রাজ্য সরকারের কাছে তাদের সংখ্যাটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। পরের দিককার অভিবাসীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নিম্নবর্ণের লক্ষ লক্ষ লোক পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং বর্তমান ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং মহারাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ও আধা-শুষ্ক বনাঞ্চল দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তুদের জন্য বসতি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তীর কাছে জানা যায় যে, বামরা, তখনকার বিরোধীদল, মধ্য ভারতের বিভিন্ন শিবিরে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর এই সরকারী পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল। তারা তাদের বাংলায় বসতি স্থাপনের পক্ষে ছিল।
দীপ হালদার লিখেছেন যে, মরিচঝাঁপির থেকে বেঁচে ফেরা অনেকেই তাকে বলেছিলেন যে, জ্যোতি বসুসহ বাম নেতারা তাদের বক্তৃতায় বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অভিবাসীদেরকে বাংলার অংশ করে নেয়া হবে। সুতরাং ১৯৭৭ সালে যখন বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে তখন সেটাকে দণ্ডকারণ্যে অবস্থানরত শরণার্থীরা ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ বলে ধরে নেয়।
তবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর বামপন্থীরা তাদের রুপ পাল্টায়। সেসময়ের মুখ্যমন্ত্রী বসু এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা সবাইকে এখানে বসতি স্থাপন করতে দিতে পারি না। তাদের অনেকেই (শরণার্থী) অবৈধ বসতি তৈরির চেষ্টা করছে, যা অনুমোদন করা উচিত নয় “।
দীপ লিখেছেন যে, অনেক হতাশ উদ্বাস্তু বাম সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী রাধিকা ব্যানার্জীর কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিল, এই বলে যে রাজ্য যদি তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু না করে, তবে তারা নিজেরাই ফিরে যেতে বাধ্য হবে – এবংতারা শেষমেশ সেটাই করেছে।
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দণ্ডকারণ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে দেড় লক্ষেরও বেশি উদ্বাস্তু বাংলার হাসনাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে চলে যায়। তারা বাংলায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। যাইহোক, ১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা এবং শিশু সফলভাবে মরিচঝাঁপিতে গিয়ে পৌঁছায়।
অধ্যাপক চক্রবর্তী তার লেখায় মরিচঝাঁপির ঘটনাকে একটি ক্লাসিক কেস বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ সেখানকার উদ্বাস্তুরা কিছু এলাকা সাফ করেছে এবং নিজেদের মতো করে স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করেছে, এমনকি রাজ্যের কোনো সাহায্য ছাড়াই দোকান বসিয়েছে। দীপও তার বইতে লিখেছেন যে ,উদ্বাস্তুরা সুন্দরবনের বন্য এলাকাকে একটি সমৃদ্ধ গ্রামে রূপান্তরিত করেছিল।
তবে সরকার এই বসতি স্থাপনের বিপক্ষে ছিল। তাই দ্বীপ থেকে উদ্বাস্তুদের অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং কিছু অংশে কাজও শুরু হয়। শুরুটা হয় অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে। কারণ দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন ছিল এবং যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। পুলিশ দ্বীপটিকে অবরুদ্ধ করে ওষুধসহ বিভিন্ন সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। ফলে বহু মানুষ মারা যায়।

১৯৭৯ সালের ১৪ থেকে ১৬ মে এর মধ্যে চূড়ান্ত আক্রমণটি ঘটে। পুলিশ দ্বীপে প্রবেশ করে প্রায় ৬ হাজার কুঁড়েঘর জ্বালিয়ে দেয়। দ্বীপে অবস্থানরত গ্রামবাসীদের কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে সেখান দণ্ডকারণ্যে পাঠায়। এক রাতের মধ্যেই, দ্বীপটি থেকে সমস্ত শরণার্থীদের সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো। দীপ তার ‘ব্লাড আইল্যান্ড’- বইয়ে লেখেন, “ধর্ষণ, খুন এবং বিষপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছিল। মৃতদেহ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। কমপক্ষে ৭ হাজার পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল।”
চক্রবর্তী বলেছেন যে, ঠিক কতজন মারা গেছে, তা জানার কোনো উপায় নেই, কারণ এই দু’দিনে, যখন অপারেশন শুরু হয়েছিল, তখন কাউকে মরিচঝাঁপিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। “কিন্তু আমার অনুমান যে ৫ থেকে ৬ হাজার মারা গেছে।”
বামেরা কেন এমন আচরণ করল?
সরকারীভাবে দেখানো কারণ ছিল, শরণার্থীরা মরিচঝাঁপির মতো একটি সংরক্ষিত দ্বীপের বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করছে। তবে অনেকেই মনে করেন, আসল কারণটি ছিলো রাজনৈতিক। অধ্যাপক চক্রবর্তীর মতে, কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন কাজ করতে পারে এবং ক্ষমতায় আসলে পরে তার অবস্থান পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারে, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে এটি স্থানীয় রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বৃহত্তর উদ্বেগের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষার উদাহরণও বটে।
ঠিক সেই সময়েই ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডব্লিউএফ) বাংলার সুন্দরবন এলাকায় প্রজেক্ট টাইগার তৈরির পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। বাঘ প্রকল্পের জন্য প্রচুর এলাকা সংরক্ষণ করা হচ্ছিল – যার ফলস্বরূপ বামরা এই বসতি স্থাপনকারীদের সংরক্ষিত এলাকায় বসতি গড়তে দিতে চায়নি।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশন থেকে প্রজেক্ট টাইগারের জন্য কতটা তহবিল এসেছিল, সেটা আমরা আজও জানি না । আমরা জানি না যে, টাকার কিছু অংশ সমসাময়িক সময়ের স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও আমলাদের হাতে গিয়েছিল কিনা।

কিন্তু আফ্রিকায় এরকম উদাহরণ বিস্তর আছে। সেখানে ১৯৮০-১৯৯০ এর দশকে প্রচুর এলাকা সাফ করে স্থানীয় সরকারের সহায়তায় সেখানে প্রাণী সংরক্ষণ ও সুরক্ষা পার্ক তৈরির অভিযোগ আনা হয়েছে ডব্লিউডব্লিউএফ এর বিরুদ্ধে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, প্রচুর টাকা হাত বদল হয়েছে। কিন্তু মরিচঝাঁপিতেও এরকম কিছু ঘটেছে কিনা সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবে হয়ে থাকলে উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে সরকারের এমন পদক্ষেপের একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
হালদার তার বইতে লিখেছেন, সরকারী পদক্ষেপের পিছনে সরকারী কারণ হলো মরিচঝাঁপি একটি সংরক্ষিত দ্বীপ এবং উদ্বাস্তুরা গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছিল। আজ, মরিচঝাঁপিতে টাইগার রিজার্ভ দফতরের একটি খালি অফিস ছাড়া কিছুই নেই।#
সূত্র: টাইমস নাউ নিউ