রাশিয়ার আক্রমণ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুদের তুলনামূলকভাবে সাদরে গ্রহণ করেছে পশ্চিম ইউরোপ। যদিও আফ্রিকা, এশিয়া এবং আরব-ভাষী অঞ্চলে সংঘাতের পর একই রকম দুর্দশার শিকার যারা হয়েছে, তাদের সঙ্গে এই ঘটনার বিপরীত চিত্র ঘটতে দেখা যায়।
ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা জোনাস পোহের রাসমুসেন এর অ্যানিমেটেড প্রামাণ্যচিত্র ফ্লি আফগানিস্তানের এমনই একজন শরণার্থীর স্মৃতিকথায় মোড়ানো। যিনি নিজের দেশ, পরিবার, শিকড় এবং ভিটেমাটি হারানোর অর্থ কী এবং এর বেদনা বা অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন হয়, তা বর্ণনা করেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেলে।
২০২১ সালে এই অ্যানিমেটেড প্রামাণ্যচিত্রটি অস্কারে সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র, সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র এবং সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার তিনটি বিভাগ মনোনীত হয়েছিলো। যদিও এটা কোনো পুরস্কার জিততে পারেনি।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আমেরিকান অস্কার ভোটাররা কী এই প্রামাণচিত্রটিকে সচেতনভাবে পুরস্কৃত করা থেকে এড়িয়ে গেছেন? যেটা কিনা পরোক্ষভাবে তাদের দেশ থেকে আফগানিস্তান পরিত্যাগের কথা মনে করিযে দেয়! নাকি ভোটাররা উদ্বাস্তু অভিজ্ঞতার বাস্তবতা তুলে ধরে এমন বেদনাদায়ক চলচ্চিত্রের চেয়ে আরো বেশি উৎসাহী কিছু খুঁজছিলেন?
ফ্লি তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে আপোস করতে নারাজ। বলা যায়, এটা কেবলমাত্র বাস্তুচ্যূতদের ভ্রমণের যন্ত্রণাকে ধরে রাখে না। প্রামাণ্যচিত্রটি মূলত রাসমুসেন এবং আমিন নবাবী বলে পরিচয় দেওয়া একজন ব্যক্তির মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার হয়েছিলো, তার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য এখানে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আমেরিকান অস্কার ভোটাররা কী এই প্রামাণচিত্রটিকে সচেতনভাবে পুরস্কৃত করা থেকে এড়িয়ে গেছেন?
অ্যানিমেশনটি আমিনের জন্য নিখুঁত ঢাল এবং রাসমুসেন ও তার দলের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচলিত সীমানাকে ভেঙ্গে দিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। আমিনের সঙ্গে রাসমুসেনের কথোপকথন আফগানিস্তান থেকে ডেনমার্কে তার যাত্রাপথের স্মৃতি ফিরে পেতে সাহায্য করে। চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের (অনীল কাপুর এবং বিবেক মুশরান) সঙ্গে তাস খেলার সময় তাদের মুখের দিকে প্রেমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। এদিকে আবার বেলজিয়ান মার্শাল আর্ট তারকা জ্যঁ ক্লদ ভ্যান ড্যামের জন্য তার হৃদয়ে বিশেষ এক অনুভূতি রয়েছে। আমিন সমকামী, কিন্তু সেটা সে স্বীকার করে না এখনও।
১৯৮০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইন্ধনে আফগানিস্তানে যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিলো, তার প্রভাব আমিনের পরিবারের উপর আঘাত হানে। ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে আমিন তার মা এবং তিন ভাইবোনের সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যায়।
কারণ মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সরকার স্থানীয় বিদ্রোহীদের হাতে পড়ে। এরপর পরিবারটি মস্কোতে চলে যায়। সেখানেও আমিন নিজেকে আবিষ্কার করে আরেকটি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত শাসন ব্যবস্থার মাঝখানে। ততোদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই ভেঙ্গে পড়েছে এবং কম্যুউনিস্ট রাষ্ট্রও ভেঙ্গে গেছে। সুপারমার্কেটের সব তাক খালি। অপরাধ এবং দুর্নীতির পথে রাজত্ব করছে তারা।
আরো পড়ুন:
দ্য ইমিগ্রান্ট : অভিবাসী চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে অথৈ জলে ভাসা জীবনের গল্প
চলচ্চিত্রে অভিবাসী: পথে পথে বিভৎস বেদনার গল্পগাঁথা
এবার আমিন ও তার পরিবার মস্কো ছেড়ে সুইডেনে চলে যাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যেখানে তার ভাই থাকেন একা। সেখানে তিনি দিন কাটান তীব্র কষ্ট, অপ্রতিরোধ্য ভয় এবং চরম বেদনার মধ্যে। প্রামাণ্যচিত্রটি মোটেও ক্ষণিকের বেদনাকে মসৃণভাবে সুখ-লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্যামেরা-বান্ধব গল্প নয়। এটি আমিনের ভয়েসওভার আত্ম-পরিচয় মুছে ফেলার একটি অনুস্মারক। যেটা শরণার্থীদের নিজেদের স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত।
ডেনিশ এই প্রামাণ্যচিত্রটির ইংরেজি সংস্করণ ওটিটি প্লাটফর্ম জি ফাইভ-এ পাওয়া যাচ্ছে। যেটা জি এর বিশেষ প্রকল্পের অংশ। ভারতীয় দর্শকদের কাছে একটু কঠিন হলেও কিন্তু প্লাটফর্মটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র আনার জন্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ইংরেজি সংস্করণে আমিন এবং রাসমুসেনের হয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন রিজ আহমেদ ও নিকোলজ কোস্টার-ওয়ালদাও। অভিনয়শিল্পীরাও নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছে। আমিনের অবিশ^াস্য যাত্রা আহমেদের চলমান বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেটা পুরোটাই সংযত আবেগ ও হাস্যরসপূর্ণ কালো মুহূর্তে ভরা।
আর্কাইভাল নিউজ ফুটেজ যেটা অ্যানিমেশনের সঙ্গে মিশে আমিনের বর্ণনাকে আরো বেশি সত্য ও জীবন্ত করে তোলে। এধরনের মর্মান্তিক ঘটনাগুলির ফ্ল্যাশব্যাক মানব পরিসংখ্যানের রুপরেখায় বিচক্ষণ অঙ্কনে রেন্ডার করা হয় শুধুমাত্র। ৮৯ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রটির তীব্রতা মাঝেমধ্যে দেখা কঠিন বা কষ্টকর হয়ে উঠবে, কিন্তু এর সততা সমানভাবে অবিস্মরণীয়।
লেখক: রীতা জান্নাত, চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল ম্যাজিক লণ্ঠন এর সদস্য এবং সাংবাদিক