১৯৯৬ সালে কারিনা অ্যামবার্টসোমিয়াম তার মা-বাবার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, যখন তার বয়স ছিলো আট বছর। তার বাবা-মা ছিলেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক। তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখান করে। একইসঙ্গে একটি কঠোর নিয়ম করে শরণার্থীদের জন্য: প্রমাণ করতে বলা হয়, তারা যে দেশের নাগরিক সেই দেশ তাদের নিপীড়ন করছে এবং উচ্ছেদ করেছে।
এরপর কারিনা এবং তার মা নাগরিকত্বের জন্য ইউক্রেনে আবেদন করেন। কিন্তু ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারাও জানায় যে, তারা আশ্রয়ের যোগত্যা অর্জন করেননি। এর ফলে কারিনা এবং তার পরিবার আজ রাষ্ট্রহীন। কোনো জাতীয়তা নেই তাদের।
‘নিউ ইয়র্ক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর দ্য সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ এর অনুমান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ লাখ রাষ্ট্রহীন মানুষ বসবাস করে। যদিও বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রহীন মানুষের নির্দিষ্ট সংখ্যা বিষয়ে কোনো প্রামাণ্যিক ঐক্যমত নেই। ইনস্টিটিউট অন স্টেটলেসনেস অ্যান্ড ইনক্লুশন, বেসরকারি সংস্থাটির অনুমান, বিশ্বব্যাপী এই রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি।
কারিনা এবং তার পরিবার অন্যান্য স্থায়ী আইনি মর্যাদার জন্য আবেদন করায় অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পেরেছিলেন। তা সত্ত্বেও তারা ক্রমাগত নির্বাসনের হুমকির মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন। পাসপোর্ট না থাকায় তারা আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারেননি এবং তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও বাড়িভাড়া নিতে অসুবিধা হয়েছিলো। অবশ্য কারিনার মা-বাবা একটি ব্যবসা শুরু করতে সক্ষম হওয়ায় প্রতি বছরই কর প্রদান করেছেন।
অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রহীনতার কারণে চাকরি পাওয়া কিংবা শিক্ষা অর্জন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কুয়েত এবং মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রহীনরা নিয়মিতভাবে বৈষম্যের শিকার হয় বা তার চেয়েও খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
আরো পড়ুন:
রাষ্ট্রহীনতার অসহায়ত্ব: পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের দুর্দশা আর কবে ঘুচবে?
১৯৫৪ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন একজন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিকে একক হিসাবে সঙ্গায়িত করে। অর্থাৎ ‘যাকে কোনো রাষ্ট্র তার আইনের অধীনে জাতীয় হিসাবে বিবেচনা করে না।’ রাষ্ট্রহীনতা কেমন হয়, সেটা অনেক আমেরিকানদের পক্ষে উপলব্ধি বা ধারণা করা বেশ কঠিন। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিক হয়ে যায়। কিন্তু এটা আবার সব জায়গায় একরকম নয়।
বিভিন্ন দেশে এমন উল্লেখযোগ্য শ্রেণির মানুষ রয়েছে, যাদের সরকার নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত দেয় না। এবং যাদের অন্য কোথাও নাগরিকত্ব নেই। ১৯৮২ সালের প্রণীত একটি আইন রাখাইন রাজ্যেও দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমানের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করে। তাদের বিদেশি, অবৈধ অভিবাসী কিংবা বাঙালিসহ নানা নামে অভিহিত করে।
২০১৭ সালে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। বাংলাদেশ তখন তাদেরকে একটি বিশাল আশ্রয় শিবিরে রাখে। যেটা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম আশ্রয় শিবির। বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় তারা অন্তত বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পেয়েছে।
যদিও বর্ষা ঋতুতে এই ক্যাম্প পরিদর্শন করলে বোঝা যায়, এই মানুষগুলো এখন ভয়বাহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এমনকি ফোরটিফাই রাইটস এর একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলেছিলো যে, তারা নিরাপদে মিয়ানমার ফিরতে পারবে না। এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের সমাজে একিভূত করতে প্রস্তুত নয়। এই শিবিরে পাঁচ বছর থাকার পর তারা ক্রমশ হতাশবোধ করছে।
আরো পড়ুন:
একজন মাহা মামো লাখো রাষ্ট্রহীন মানুষের আলোর দিশারী…
কুয়েতে বিদুন সম্প্রদায়ের এক লাখ বেশি সদস্য রয়েছে। যাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানে বসবাস করছে। সংখ্যালঘু অধিকার গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের মতে, ‘বেশিরভাগ বিদুন আরব উপদ্বীপের যাযাবর উপজাতি থেকে এসেছে। এরা ১৯৬১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করার সময় কুয়েতে ছিলো। কিন্তু নাগরিক হিসাবে নিবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় নিতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ছিলো।’
১৯৮৫ সালে যারা সরকারি চাকরি করছিলো, সরকার সেই সমস্ত বিদুনকে বরখাস্ত করেছিলো। সেইসঙ্গে দেশে বিদুনদের বসবাস অবৈধ ঘোষণা করেছিলো। এটিই এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের এই ছায়ার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করেছে। যারা আইনিভাবে কাজ করতে অক্ষম, এমনকি পুলিশ সুরক্ষা চাইতেও ভয় পায়।
কারিনা এবং তার পরিবারের মতো কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাক্তন সোভিয়েত থেকে দেশত্যাগ করেছিলো। কিন্তু সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে ইউক্রেনের মতো দেশে নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য ছিলো না তারা। কিছু রাষ্ট্রহীন মানুষ কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপে বসবাস করছে। তারা পাসপোর্ট পায় না। গুরুতর অসুস্থ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়কে দেখতে এমনকি তাদের বাবা-মায়ের শেষকৃত্যে যোগ দিতে অক্ষম। এবং এটি তাদের চাকরি পাওয়া বা ধরে রাখার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে জটিল করে তোলে।
বছরের পর বছর ধরে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর দৃঢ়ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে তাদের আইন সংশোধন করার জন্য, রাষ্ট্রহীন মানুষদের মর্যাদা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এটা যদিও আংশিকভাবে, কারণ এই সমস্যাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব কম জনসাধারণের মনোযোগ পেয়েছে। এটি ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকান প্রশাসন দ্বারা অগ্রসর হয়নি।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি আলেজান্দ্রো মায়োরকাস ডিসেম্বরে রাষ্ট্রহীনতার বিষয়টি উত্থাপন করে ‘উল্লেখযোগ্য মানবিক উদ্বেগ’ স্বীকার করে প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিসহ, ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’
আরো পড়ুন:
রাষ্ট্রহীন শিশুদের ভবিষ্যৎ কী?
বাইডেন প্রশাসনের নতুন আইন ছাড়াই কাজের অনুমোদন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সুবিধাগুলি বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রহীন মানুষদের স্থায়ী ত্রাণ পেতে এই ব্যবস্থাগুলি সহায়তা করবে না। যতক্ষণ না কংগ্রেস তাদের স্থায়ী বসবাসের জন্য এবং শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য করে তোলার জন্য আইন সংশোধন করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অনেক রাষ্ট্রহীন মানুষ, কারিনা ও তার পরিবারের মতো, ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর অথবা মিয়ানমার এবং কুয়েতের মতো জায়গায় কঠোর নাগরিকত্ব আইনের কারণে অভিবাসী হয়েছিলো। তারা এখানে বসবাস করেছে এবং কাজ করেছে। কর প্রদান করেছে এবং সমাজের কল্যাণে অবদান রেখেছে।
কারিনা এখন ৩৪ বছর বয়সী। আরও কয়েকজন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার জন্য মার্কিন আইন ও নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের জন্য প্রচারণা চালানোর জন্য ইউনাইটেড স্টেটলেস নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন। এবং অবশই ন্যায়পরায়ন আমেরিকানদের সমর্থন পাওয়ার যোগ্য।
সূত্র: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ