গ্রিস সরকার অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রবেশ ঠেকাতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পুশব্যাক পন্থার প্রয়োগ করে আসছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই দেশটি অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রবেশ বন্ধে আরেকটি বিতর্কিত কৌশল প্রয়োগ শুরু করেছে বলে সরাসরি অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের বরাতে প্রতিষ্ঠানটি গ্রিসের বিরুদ্ধে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এই নীতিকে আইন বহির্ভূত হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি, নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বা সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরত রেখে তৃতীয় দেশের অভিবাসী দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের অবৈধ পুশব্যাক করছে গ্রিস।
‘গ্রিক কর্তৃপক্ষ তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করে ইভ্রোস নদী দিয়ে তুরস্কে ফেরত পাঠানোর আগে আফগান আশ্রয়প্রার্থী এবং শিশুসহ অভিবাসন প্রত্যাশীদের ওপর আক্রমণ, ছিনতাই ও হেয় করছে’-বলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ৭ এপ্রিল তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে গ্রিসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি আনে। প্রতিবেদনে সংস্থাটি ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অবৈধ পুশব্যাকের একটি বিস্তারিত ‘পদ্ধতি’ বর্ণনা করে। যা একইসঙ্গে অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা, কাউন্সিল অব ইউরোপ ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক সমর্থিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর মতে, মুখোশধারী ব্যক্তিরা, যাদের মধ্যে কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূত। তারা ইভ্রোস নদীতে নিয়মিত নৌযান চালাচ্ছেন, যা তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার স্থল সীমান্তের বেশিরভাগ অংশকে চিহ্নিত করেছে এবং অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগে নামতে বাধ্য করছে। এই ব্যক্তিরা অভিবাসন প্রত্যাশীদের গ্রিসের সীমনা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নদীর তুরস্কের অংশে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
মূলত এই অভিযোগগুলি ২৬ আফগান অভিবাসন প্রত্যাশীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৩ জন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে, তাদের সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর মধ্যে পুশব্যাক করা হয়েছিল।
অভিবাসীরাই অভিবাসীদের পুশব্যাক করছে
একজন সাক্ষাৎকারদাতা বলেছেন, তার নৌযানটি দুইজন আফগান ও দুইজন পাকিস্তানি ছিনিয়ে ইভ্রোস নদীর ওপাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। পশতু ভাষায় কথা বলতে গিয়ে এই ব্যক্তিরা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, পুলিশ তাদের নদীর ওপাড়ে অন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে। কারণ গ্রিক পুলিশ ‘‘মানুষের তুরস্কে ফেরত পাঠানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত হতে চায় না’’।
অন্য আরেকজন অভিবাসন প্রত্যাশী বলেন, নৌকার একজন চালক, যিনি পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা এখানে আছি… তিন মাস ধরে এই কাজটি করছি এবং তারপর তারা আমাদেরকে… তিন পৃষ্ঠার একটি নথি দেয়। এই নথি দিয়ে আমরা অবাধে গ্রিসের ভিতরে চলে যেতে পারি এবং তারপর আমরা অন্য দেশের জন্য টিকেট কাটতে পারি।’
২৫ বছর বয়সী বেদার (ছদ্মনাম) নামের আরেক আফগান সাংবাদিক তালেবানদের হাত থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মামলায় তিনি বলেন, নৌকায় চালকরা সিরিয়ান এবং আরবি ভাষায় কথা বলছিলেন। সাক্ষাৎকারে দুজন নারী, যারা তাদের সন্তান এবং স্বামীর সঙ্গে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন যে, তাদের পোশাক সরাতে বলা বলা হয়নি। তবে তারা এই অভিযোগটি করেছেন যে, তাদের ফোন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তাদেও কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এছাড়া আটক করে রাখা একজন নারীকে তার মেয়ে থেকে আলাদা করা হয়েছিল।
তুরস্ক ‘নিরাপদ’ দেশ হিসেবে আখ্যায়িত হয়
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর দাবি, অভিবাসন প্রত্যাশীদের তুরস্ক সীমান্তে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রিসের ভিত্তির অংশ হলো, ২০২১ সালের জুনে গ্রিস তুরস্ককে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও সোমালিয়া থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। এর মানে দাঁড়ায়, যদি এইসব দেশের নাগরিকরা গ্রিসে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ঘোষণা গ্রিসের পরিবর্তে তুরস্কে ঠেলে দেয়ার পক্ষে জোড়ালো প্রমাণ দাঁড় করাতে পারে গ্রিস সরকার।
যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উল্লেখ করেছে যে, তুরস্ক ইইউ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘নিরাপদ দেশ’ এর মানদণ্ড পূরণ করে না। কারণ হিসেবে তাদের ভাষ্য, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, তুরস্ক তার শহরগুলি থেকে শত শত সিরিয়ানকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করেছে।
এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর কাছে সাক্ষাৎকারদাতারা দাবি করেছে যে, তারা গ্রিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সঠিকভাবে নিবন্ধিত হয়নি বা তাদের আশ্রয় দাবি করার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।
সূত্র: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ