যেন হরেক রকম দাসের পসরা। থরে থরে সাজানো রয়েছে কালো, সাদা, উঁচু-লম্বা, বেঁটে, শিশু, তরুণ, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ, পেশীবহুল-নানান ধরনের ‘দাস’। আপনি যদি বিত্তবান কিংবা মোটামুটি স্বচ্ছল হন, তাহলে এই হাঁট থেকে কয়েক দিন বা মাসের জন্য কিনে নিতে পারেন পছন্দসই এক বা একাধিক ‘দাস’। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন, দাস কেনা-বেঁচার এই সুযোগটি শত শত বছর আগের ক্রীতদাস প্রথার সময়কার জমজমাট কোনো দাস কেনা-বেঁচার হাঁট-বাজারের গল্প?
না, তাহলে একটু ভুল ভাবছেন। কারণ ‘দাস’ কেনা-বেঁচার এই গল্প আজকের সময়ের এবং তা খোদ এ দেশেরই। যখন বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের হাতে, যখন বলা হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ে পাশের দেশ ভারতকেও পরাস্ত করেছে বাংলাদেশ, ঠিক এরকম এক সময়ে শত শত বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ক্রীতদাস প্রথার এই ভিন্নরূপে ফিরে আসার দৃশ্য আগন্তুকদের কাছে সত্যিই বেমানান লাগে।
এতক্ষণ যে হাঁট প্রসঙ্গে এত কথা হলো, সেটির নাম কিষাণের হাঁট। খুলনা জেলার ডুমুরিয়ার উপজেলার কালীবাড়ী মোড়ে প্রতি শুক্র আর সোমবার এই হাঁট বসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন, অস্বচ্ছল, ভূমিহীন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের শিকার দিনমজুর শ্রমিকরা এখানে ভিড় করে। মূলত শ্রম বিক্রিই তাদের উদ্দেশ্য। ফলে যে কেউ চাইলে দিন কিংবা মাসের হিসাবে তাদেরকে কিনে নিতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী কিনে নেয়ার পর ইচ্ছে অনুযায়ী ফসলের মাঠের ধান কাঁটা, বাড়ি বানানো, মাটি কাঁটা, গৃহস্থালিসহ যেকোনো কাজ তাদেরকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে ক্রেতারা। বিনিময়ে সামান্য কিছু টাকা পেলেই তারা সন্তুষ্ট।
কিষাণের হাঁটের গোড়াপত্তন সম্পর্কে ডুমুরিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দা মো. মোকসেদ আলী ও চিত্ত দাসসহ আরো কয়েকজন বায়োজেষ্ঠ্য’র সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে দুর্ভিক্ষের কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকায় চড়ে, পায়ে হেঁটে এখানে মানুষের শ্রম বিক্রি করার রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল। তবে মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সাল থেকে কালীবাড়ির মোড়ে নিয়মিতভাবে কিষাণ বিক্রির এ হাঁট বসে এবং ধীরে ধীরে তা সারা দেশের উদ্বাস্তু দিনমজুর ও শ্রমিকদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
পাঁচ দশকের পুরোনো এ হাঁটটির অবস্থা সরেজমিনে দেখতে অভিবাসী ডটকম গত শুক্রবার সকালে ডুমুরিয়ার কালীবাড়ী মোড়ে যায়। এখানে এসে দেখা যায়, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের দুই পাশ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন দূর-দূরান্ত থেকে ছুঁটে আসা নানা বয়সী শত শত শ্রমিক। কারো কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, কারো মাথায় মাস্তুল, কারো হাতে কোঁদাল। সবারই অপেক্ষা কখন বিক্রি হবেন তারা!
কাছে গিয়ে ষাটোর্ধ একজনকে প্রশ্ন করা হয়: আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আলাপের শুরুতেই তীর্যক স্বরে তার দেয়া উত্তরটি শুনে হতবাক হতে হয়: ‘আমরাতো গরীব, চাষা, দাসও বলতি পারেন, তাই এখানে বিক্রি হতি আইছি বাপু।’ পাশে থাকা আরেকজন এই ব্যক্তির কথা লুফে নেন। বলেন, ‘কিষাণের হাঁট না বইলে বলেন, দাসের হাঁট, এখানে দাস বিক্রি করা হয়। আমরা দাসের চাইতে কম কিসের! আমাগের শরীলডাই খালি (শুধু) আছে। খাঁটতি (পরিশ্রম) পারি, তাই এই হাঁটে আইছি, যদি কেউ কেনে।’ জানালেন, ফজরের আজানের আগেই কয়রা থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন তিনি। সকাল থেকে এখনো তাকে কেউ কেনেনি। যদি তিনি বিক্রি না হন, তাহলে আবার ফিরে যেতে হবে তার বাড়িতে। অথচ এই হাঁটে আসা-যাওয়া ও খাওয়া বাবদ তার প্রায় চারশো টাকা খরচ হবে এবং এই টাকার পুরোটাই তিনি প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করেছেন।
আগ্নেয়াস্ত্র নয়, বোমা নয়, লবন পানিই মরণাস্ত্র
অভিবাসী ডটকম এর সঙ্গে কথা বলতে এসময় আরো অনেকে তড়িঘড়ি শুরু করেছে। কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, তাদের ভেতর কষ্ট-বেদনা-দুঃখের স্রোতধারা বয়ে চলেছে। নিজেদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে একটু হালকা হওয়ার জন্যই বোধহয় মনে যা আসছে, তা এ প্রতিবেদকের সামনে বলে চলছিল।
কয়রার মঠবাড়ির নজরুল এমনই একজন। নিজের এলাকা ছেড়ে কেনো তিনি এতদূরের এই হাঁটে শ্রম বিক্রি করতে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘গত ১০-১৫ বছর ধরে আমাদের এলাকার সমস্ত কৃষি জমিতে লবন পানি ঢুকে গেছে। এখন কোনো ফসলই হয় না। আমরাতো এই কৃষি কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ পারি না। তাই বেকার বসে থাকতে হয়। একারণে অত দূর থেকে এখানে এসেছি নিজের শ্রম বিক্রি করতে। লবন পানি আমাদের জন্য অভিশাপ।’
এসময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাইকগাছার গড়ুইখালির আতাউর রহমান যেন খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘প্রতিদিনই নোনা পানি ঢুকে পড়ছে আমাদের এলাকায়। চাষবাষ কিছুই করার উপায় নেই। নিজের জমি নেই, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করতাম, তাও গত ১০-১২ বছর ধরে বন্ধ।’ কৃষিজমিতে লবন পানি ঢুকে পড়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের যারা, টাকাওয়ালা, ক্ষমতাবান, তারা একরের পর একর জমিতে বিরাট বিরাট চিংড়ি মাছের ঘের করছে। এই চিংড়ি ঘেরের দখলে প্রতিদিনই কৃষিজমি চলে যাচ্ছে। এর ফলে নোনা পানি ঢুকে পড়ছে সবখানে।’
জনাব আতাউর রহমান যখন চিংড়ি ঘের প্রসঙ্গে এমন কথা বলছেন তখন তার কথার সমর্থনে চারপাশের ভিড় থেকে ‘ঠিক ঠিক’ বলে রব উঠলো। তাদের সবারই অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ীরা একটু একটু করে কয়রা-পাইকগাছা-সাতক্ষীরা অঞ্চলের বেশিরভাগ কৃষিজমিই চিংড়ি ঘেরে রূপান্তরের চেষ্টা করছে। এমনকি যারা চিংড়ি ঘের না করে ফসল করতে চান, তাদেরও জোরজবরদস্তি করা হয় চিংড়ি ঘেরের জন্য জমি ছেড়ে দিতে।
কয়রার গিলেবাড়ির মিঠু উদাহরণ দিয়ে অভিযোগ করলেন এভাবে, ‘ধরুন আপনার এক বিঘা কৃষি জমি আছে। আর তার পাশে ২০ বিঘার একটি চিংড়ি ঘের। তখন ওই ২০ বিঘা চিংড়ি ঘেরের মালিক আপনার এক বিঘা জমি তাকে দিয়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। যদি আপনি না দিতে চান, তাহলে প্রয়োজনে তারা হুমকি দিবে। তাতেও কাজ না হলে আপনার ওই এক বিঘা জমিতে আপনি কোনো চাষবাষ করতে চাইলে সরাসরি বাধা আসবে। একটা সময় বাধ্য হয়েই জমি হারি (বর্গা) দিতে হয়। ঠিক এভাবেই মাইলের পর মাইল জমি আজ লবন পানির আধারে পরিণত হয়েছে।’
উত্তরবঙ্গ থেকেও এই হাঁটে শ্রম বেঁচতে মানুষ আসে
রাস্তা পেরিয়ে অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানা গেল, তাদের কেউ এসেছেন গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুর থেকে, কেউবা নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। অত দূর থেকে এত সময়, অর্থ খরচ করে এই হাঁটে আসার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ওইসব অঞ্চলের জমিতে এই মৌসুমে তেমন কোনো চাষবাষ করা হয় না।
মূলত ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পুরো পদ্মা, তিস্তা মরুভূমির মতো হয়ে যাওয়ায়, ওই সব অঞ্চলে চাষবাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানির তীব্র সংকট থাকায় চাইলেও চাষবাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে বেকার হয়ে পড়া শত শত শ্রমিক, চাষী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিযায়ী হিসেবে চলে যান এবং সামান্য শর্তে মানুষের বাসাবাড়ি ক্ষেতখামারে কাজ করেন। জিএম শহিদুল ইসলাম তাদেরই একজন। কাছে গিয়ে জানতে চাওয়া হয়, তার এই হাঁটে আসার কারণ সম্পর্কে। ‘গ্রামে থেকে কী করবো, কোনো কাজকর্ম নেই। বেকার হয়ে পড়ে থাকতে হয়। স্ত্রী-ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতেই এখানে শ্রম বিক্রি করতে এসেছি।’
নওগাঁর হাবিবুর রহমান প্রায় ১৮ ঘণ্টা ভ্রমণ করলেও তার চোখেমুখে কোনো ক্লান্তি কিংবা দুঃখের ছাপ দেখা গেল না। বরং অন্য সবার সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন তার মুখে যেন হাসির পসরা বসেছিল। ‘দুঃখ করে কী লাভ বলেন? গরীব হয়ে জন্মেছি। কষ্ট তো করতেই হবে।’ এই কিষাণের হাঁটে আপনারা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, নিজেদের শ্রম বিক্রির জন্য ক্রেতার অপেক্ষা করছেন, এ বিষয়টিকে কেমন হয়? ‘কি আর মনে হবে, আমরা হইলাম মাল, মালিক কিনে নিয়ে যাবে। ইচ্ছেমতো কাজে লাগাবে। কয়টা টাকা দেবে, এর চেয়ে আর বেশি কিছু ভাবি না’-বলেন হাবিবুর।
কুড়িগ্রামের বাসিন্দা জনাব সিদ্দিক জানালেন, তার গ্রাম থেকে এখানে আসা-যাওয়া থাকা-খাওয়া বাবদ প্রায় ২ হাজার টাকা শেষ হয়ে গেছে। তবে কাজ পেলে কিছুটা উসুল হবে বলেও নিশ্চয়তা দেন তিনি। আরো জানালেন, এই হাঁটে তিনি গত সাত-আট বছর ধরে নিয়মিত আসেন।
এদিকে চোখ ঘোরাতেই দেখা গেল, ডুমুরিয়া পাইকারি বাজারের যে দোকানগুলোতে সাধারণ কাঁচামাল রাখা হয়, সেখানে ক্লান্ত-বিষন্ন হয়ে অনেক শ্রমিক, দিনমজুরকে শুয়ে আছেন। অনেক দূর থেকে রওয়ানা দেয়া এবং না খেয়ে থাকার কারণে তাদের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ এতটাই প্রকাশ পাচ্ছিলো যে, তাদের সঙ্গে আর কথা বলার সাহস হলো না।
এই কিষাণের হাঁটের শ্রমিক সম্পর্কে স্থানীয় সমাজ সেবক ও ওয়ার্কাস পার্টি, ডুমুরিয়া, খুলনা জেলার সভাপতি শেখ সেলিম আকতার স্বপন বলেন, ‘আগে এক একজনকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে হাঁটে বিক্রি করা হতো। আর এখন অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে বাধ্য হয়ে নিজেই নিজেকে স্বেচ্ছায় বিক্রি করে দিচ্ছে। ডুমুরিয়ার এই কিষাণের হাঁট সেই দাস কেনা-বেঁচার হাঁটেরই প্রতিনিধিত্ব করছে, তবে তা একটু ভিন্ন নামে, ভিন্নভাবে।’
জনাব স্বপন আরো বলেন, ‘ ১৯ শতকের পর সবাই ধরে নিয়েছিল, অভিশপ্ত এ দাস প্রথা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দাসপ্রথা ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন চেহারায়। সারা দেশে শ্রম বিক্রির এই হাঁট এবং এখানে শ্রম বিক্রি করতে আসা মানুষগুলোর প্রতিচ্ছবি যেন সেই অভিষপ্ত সময়কেই মনে করিয়ে দেয়।
তার মতে, সব হারানো নব্য দাসরা যেমন বাধ্য হয়েই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তেমনি বাজার ব্যবস্থাও এই নব্য দাসদেরকে সুবিধামতো কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছে। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল, নিঃস্ব শ্রমজীবীরা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে নয়া উদারবাদ কাঠামোয় আধুনিক দাসে পরিণত হয়েছে। যা সত্যিই মর্মান্তিক ও বেদনাবিধুর।’