পুরনো শহরের গলির মতোই গোলকধাঁধায় পড়েছে উত্তর প্রদেশের গোরখপুরের বাসিন্দা মনোজ (২৭)। প্রতি সন্ধ্যায় একটি পুরনো পুশকার্টে পানিপুরি বিক্রি করেন তিনি। গভীর রাত পর্যন্ত তার ব্যবসা চলতে থাকে। তিনি মূলত জিএম চাউনি, আল জুবেল কলোনি, ফুলবাগ এবং চন্দ্রায়ণগুট্টার মতো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার আশেপাশের জায়গাগুলিতে ঘুরে বেড়ান।
কেউ তার নাম জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ‘রশিদ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আসল পরিচয় গোপন করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেয়া কারে, দার লাগতা হ্যায়, কোন পাকদ কার পিট না দেহ’। হামারে ইয়াহা থোদা গদবধ চলতা হ্যায় না মুসলিম কো লেকার’ ( কেউ আমাকে মারবে বলে ভয়ে থাকি। বাড়ি ফিরে মুসলিমদের নিয়ে সমস্যা আছে)।
বছর ছয়েক আগে মনোজ হায়দ্রাবাদে চলে আসেন এবং তারপর থেকেই শহরের পুরনো এলাকায় পানিপুরি বিক্রি করছেন। ‘ আমি সুলতান শাহীতে ইউপি থেকে আসা কিছু বন্ধুদের সঙ্গে থাকি। আমরা যখন আবার আমাদের পুরনো শহরে থাকি তখন প্রতি মাসে তাদের টাকা পাঠাই’-বলেন মনোজ।
মনোজের মতো আরো অনেকে উপযুক্ত জীবিকার সন্ধানে প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ায় এবং অদ্ভূত অদ্ভূতসব কাজ করে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার হায়দ্রাবাদেও আসে। শহরের দক্ষিণে সুলতান শাহী নশেমাননগর, ভবানীগর এবং অন্যান্য কিছু এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন তারা।
এমনই একজন রাকেশ। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো উপার্জন করা এবং টিকে থাকা। আমরা সকল প্রকার রাজনীতি, ঘৃণা ও হিংসা থেকে নিজেদের দূরে রাখি। আমাদের নিজেদের রাজ্যে কিছু লোক আজেবাজে কাজ করে, যার কোনোটাই আমাদের কাজে আসে না। আর তাদের কারণেই আমরা অন্যত্র ভয়ে থাকি। তাদের কাজের প্রতিক্রিয়া তাদের বোঝা উচিত’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাকেশ তার নাম ব্যবহার করেই গভীর রাত পর্যন্ত হাফিজবাবানগর রোডে আইসক্রিম বিক্রি করেন।
মুসলিমবিরোধী হিংসা এবং ঘৃণাত্মক বক্তৃতার প্রতিশোধের সম্মুখীন হচ্ছেন উভয় অভিবাসীই। ঘরে ফেরার পর প্রতিদিনই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। অতি সম্প্রতি রাম নবমী এবং হনুমান জয়ন্তী থরকে কেন্দ্র করে সহিংসতা মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, দিল্লি, গুজরাট এবং অন্যান্য স্থানের মতো রাজ্যগুলিকে গ্রাস করেছে। এর ফলে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যেসব অমুসলিম অভিবাসীরা কাজ কওে, তারাও একধরণের ভয়ের মধ্যে আছে। যদিও উদ্বেগের তেমন কোনো কারণ নেই বলে স্থানীয়দের মত।
নিজ রাজ্যে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা তাদের জন্য একটি সামাজিক ভয় হয়ে দাঁড়াবে-সেই ভয় থেকেই তাদের এই আশংঙ্কা। তবে এটি লক্ষ্যণীয় যে, কর্ণাটক, দক্ষিণের একটি রাজ্য দেরিতে হলেও ভারতের নতুন সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
রাকেশের সহকর্মী রাম এ বিষয়ে আরো বলেন, ‘ভারতের সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার কারণে তার পরিবার তাকে সতর্ক থাকতে বলেছে। এমনকি এখানকার প্রবীণরা গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে নিষেধ করেছেন। শনাক্ত হওয়ার ভয়ে আমরা গাড়িতে লেবু বা মরিচ বেঁধে রাখি না। আবার হাতে সুতো বা তিলকও লাগাই না।’ মূলত যে জিনিসগুলো দেখে ধর্মীয় পরিচয় শনাক্ত করা যায়, এমন জিনিসগুলি এড়িয়ে চলার কথা বলেন তিনি।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডের মানুষের কাছে হায়দ্রাবাদ দুবাইয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। বলা হয়ে থাকে, মানুষ শূণ্য হাতে এই শহরে আসে এবং খুব কম সময়ের মধ্যে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। প্রচুর কাজের সুযোগ, কম ঘর ভাড়া এবং খাবারের মূল্য সস্তা হওয়ায় এখানে বসবাস করে শান্তি আছে বলে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন বারাণসীর বাসিন্দা বাবুলু।
তাদের মতে, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারে প্রচুর দারিদ্র রয়েছে। যে কারণে তারা টিকে থাকার জন্য এখানে কাজ করতে আসে। মূলত এখানে অনেক কারিগর হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, শাড়ি, প্রিন্টিং, চপল তৈরির মতো নানা কাজ করে থাকে। ‘করোনার কারণে শিল্পের পরিসর কমে গেছে। ফলে আমরা ছোট ছোট কাজ করছি এবং প্রতি মাসে প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা আয় করছি’- বলেন গাজিয়াবাদের স্থানীয় বাসিন্দা অজয়। তিনি আরো বলেন, ‘করোনা মহামারির পর অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে অন্যান্য রাজ্যে নতুন সাম্প্রদায়িক ঝামেলার সৃষ্টি হয়। যেটা তাদের উদ্বেগের আরেকটা বড় কারণ।
যদি ঘৃণার পরিবেশ অব্যাহত থাকে তাহলে অনেকেই মনে করেন, তাদের নিজ শহরে ফিরে যেতে হবে। কারণ তাদের ভয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ‘রোজ ফোন লাগতাহে হ্যায় ফ্যামিলি, এক দার হোগায়া হ্যায়’, বলেছেন অজয়ের এক বন্ধু। যিনি তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
সূত্র: সিয়াসাত