মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষিত থাকা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় মৃত্যু ঝুঁকি বেড়েছে। ২০২১ সালে কমপক্ষে ৬৫০ জন অভিবাসী মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে মারা গেছে
১৯৮৭, ২০০৩ ও ২০১৭ সালে পর্যায়ক্রমে অভিবাসন প্রত্যাশীদের কয়েকটি দল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে তাপ এবং ডিহাইড্রেশনের কারণে বদ্ধ কন্টেইনারে আটকা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। এর বাইরে আরো বহু ঘটনা রয়েছে, যেগুলো শত শত নিঃসঙ্গ অভিবাসী কিংবা তাদের ছোট ছোট দল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে গিয়ে মারাত্মক মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।
সোমবার দক্ষিণ সান আন্তোনিওর একটি শিল্প সড়কে অতিরিক্ত উত্তপ্ত একটি লরির মধ্যে ৫০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারকারীরা কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকাতে গিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছিলো।
মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকা থেকে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী পাচার হয়েছে। এ সময় উত্তরগামী পথ ধরে বিপুল সংখ্যক অভিবাসীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। কয়েক দশক ধরে যারা আমেরিকাতে আশ্রয় পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যেটা অস্বাভাবিক বা নজিরবিহীন কিছু নয়। তবুও সোমবারের ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটি সাম্প্রতিক স্মৃতিতে যে কোনো ঘটনার চেয়ে কম ভয়াবহ কিছু নয়। ঘটনাটি দেখে আইন প্রয়োগকারী এবং অভিবাসন সংশ্লিষ্ট মানুষেরা হতবাকই হয়েছেন বটে।
বাইডেন প্রশাসন এবং টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট উভয়ে মিলে সীমান্ত বরাবর বেশকিছু নীতি প্রয়োগ করেছে। আর এই নীতির প্রয়োগ পদ্ধতি অত্যন্ত কঠোর বলে এখানে আসার জন্য অভিবাসীরা ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন করোনাকালীন যে নীতি প্রণয়ন কওে, সেটা আশ্রয়ের শুনানি ছাড়াই অবিলম্বে অনেক অভিবাসীকে বহিষ্কার করে।
অভিবাসন কর্মকর্তারা বাইডেন প্রশাসনের অধীনে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বেশিরভাগ অবিবাহিত পুরুষ এবং কিছু পরিবারকে মেক্সিকোতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বার বার পারাপার হওয়া লোকেরা প্রশাসনের নীতির অধীনেও শীর্ষে উঠেছে। এর ফলে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বেশ কমে গেছে।
আরো পড়ুন:
আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এত অমানবিক ও কঠোর কেনো
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুরক্ষিত থাকা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় মৃত্যু ঝুঁকি বেড়েছে। ২০২১ সালে কমপক্ষে ৬৫০ জন অভিবাসী মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে মারা গেছে। যেটা আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) ২০১৪ সালে যেসকল ডাটা সংগ্রহ করেছে, সেটা অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি।
ওয়াশিংটনের আর্চডিওসিসের ক্যাথলিক দাতব্যদের অভিবাসন আইনি পরিষেবার তত্ত্বাধায়ক অ্যাটর্নি অ্যালিসন নরিস বলেন, ‘ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে সীমান্ত এখন অনেক বেশি বন্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এটি অভিবাসীদের ক্রমবর্ধমান চোরাচালানকারীদের সন্ধান করতে এবং সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার দিকে পরিচালিত করেছে।’
তিনি এও বলেন, ‘তার বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট সীমান্তে প্রবেশের সরকারী বন্দরগুলিতে অবৈধভাবে পারাপার হতে চাইবে, আশ্রয় চাওয়ার পরিবর্তে। যা সাধারণত অনেক বেশি বিপজ্জনক এবং চোরাকারবারিদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার উপায় বাতলে দেয়। তবে অভিবাসীদের বহিষ্কার বা তাদের আশ্রয়ের শুনানির জন্য অপেক্ষা করার জন্য মেক্সিকোতে রাখার বাইডেন প্রশাসনের নীতিটি আরো কঠিন ছিল।’
সোমবারের আগে সাম্প্রতিক টেক্সাসের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ মানবপাচার-সম্পর্কিত ‘গণহত্যা’ ঘটে ২০০৩ সালে। যখন ১৯ জন মানুষ শতাধিক মাইল পর্যন্ত একটি দুগ্ধ বহনকারী ট্রাকে আটকা পড়ে মারা গিয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ অনুমান করেছিলো যে, তাপমাত্রা ১৭০ ডিগ্রির উপরে থাকার কারণে ভিতরে অভিবাসীরা লরি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। লরিটি ছিল হিউস্টনগামী।
আরো পড়ুন:
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তেই ১৯ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী গ্রেফতার
লরিটি থেকে ১৭ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং পরে দুজন মারা গেছে। ড্রাইভারকে শেষ পর্যন্ত ফেডারেল অভিযোগে বিচার করা হয়েছিল এবং তাকে ৩৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সান আন্তোনিও ২০১৭ সালে আরেকটি গণ ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটেছিল। যখন একটি ওয়ালমার্ট পার্কিং লটে একটি লরি থেকে ৩৯ জনকে পাওয়া গিয়েছিল। লরিটির মধ্যেই আটজন মারা যান এবং পরে হাসপাতালে দুজন মারা যান। গাড়ির চালককে প্যারোল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
১৯৮৭ সালে সুদূর পশ্চিম টেক্সাসে একটি রেলপথের সাইডিং বক্সে আটকে থাকার পর ১৯ জন লোক মারা গিয়েছিল। যাকে সেই সময়ে একজন বর্ডার টহল কর্মকর্তা ‘ত্রুটি এবং ভুল বিচারের একটি মর্মান্তিক সিরিজ’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
মেক্সিকো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের পাচার করার জন্য বাণিজ্যিক যানবাহনের ব্যবহার করা হয়েছিলো। ইতোমধ্যেই এটা দেশে থাকা নথিভুক্ত ব্যক্তিদের স্থানান্তরিত করা একটি দশকব্যাপী সমস্যা। অ্যাবটের বিতর্কিত সীমান্ত নিরাপত্তা কর্মসূচি, অপারেশন লোন স্টারের অংশ হিসাবে গত বছর টেক্সাস-মেক্সিকো সীমান্তে ন্যাশনাল গার্ড এবং টেক্সাস ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক সেফটি সৈন্যদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে সমস্যাটি কমে গেছে এমনটা মোটেও নয়।
এই মাসের শুরুর দিকে কর্পাস ক্রিস্টিতে ২৪ বছর বয়সী মিশনের বাসিন্দা একটি লরিতে ৭৩ জনকে পরিবহন করার চেষ্টা করার জন্য ফেডারেল চোরাচালানের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তার গাড়ির তল্লাশিতে ইকুয়েডর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, পেরু, মেক্সিকো এবং এল সালভাদর থেকে কয়েক ডজন অভিবাসীকে ফালফুরিয়াসের কাছে বর্ডার পেট্রোল চেকপয়েন্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
আরো পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রে অপরিহার্য পেশায় নিয়োজিত ৬৯ শতাংশ অনিবন্ধিত অভিবাসী শ্রমিক!
জানুয়ারিতে একটি টেক্সাস ডিপিএস সৈন্য একটি লরিতে লুকিয়ে থাকা ২৮ জন অভিবাসীকে খুঁজে পেয়েছিল। চালকের বিরুদ্ধে ২৮টি মানব পাচার এবং গ্রেফতার এড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিপিএস গভর্নরের অপারেশন লোন স্টার প্রচেষ্টার মাধ্যমে হাইলাইট করার চেষ্টা করেছে যে, কীভাবে এর প্রচেষ্টা অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে কাজ করছে! এমনকি টেক্সাসে সীমান্ত অতিক্রমকারী অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় প্রতি মাসে বেড়েই চলেছে।
এজেন্সির ফেসবুক সাইটে ভিডিওতে ক্যারিজো স্প্রিংসে মার্চে একজনকে গ্রেফতার করা দেখানো হয়েছে। যেখানে একটি বাণিজ্যিক ট্রাকের ভিতরে ৭৬ জন অভিবাসীকে পাওয়া গেছে। ব্যবহৃত সমস্ত বাণিজ্যিক যানবাহন বড় ১৮-চাকার গাড়ি নয়। এপ্রিল ২০১৬-এ মিশিগানের একজন ব্যক্তিকে একটি তালাবদ্ধ পেনস্কে ভাড়ার ট্রাকের ভিতরে ১০ জন অনথিভুক্ত অভিবাসীকে অবৈধভাবে পরিবহন করার চেষ্টা করায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
বিবাদী বর্ডার পেট্রোল এজেন্টদের বলেছিল যে, সে লরেডোতে ট্রাকটি তুলেছিল এবং কর্পাস ক্রিস্টিতে নিয়ে যাচ্ছিল। ড্রাইভারের কাছে ট্রাকের পিছনের কার্গো এলাকার কোন চাবি ছিল না।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মেক্সিকো মানবপাচার রোধে নিজস্ব পুলিশি ব্যবস্থা বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে মেক্সিকো সীমান্ত কর্মকর্তাদের দ্বারা ব্যবহৃত এক্স-রে স্ক্যানাওে ধরা পড়েছিল যে, সেখানে ২০০ জনেরও বেশি অভিবাসীকে বিভিন্ন ট্রাকের গোপন বগিতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
মার্কিন পরিবহন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক স্থল যানবাহনের মাধ্যমে মানব পাচারের বিরুদ্ধে জনসংযোগ অভিযান চালিয়ে আসছেন। ফেডারেল মোটর ক্যারিয়ার সেফটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কিভাবে চোরাচালানকারীদের চিহ্নিত করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।
আরো পড়ুন:
আমেরিকার বিয়ার শিল্পে কীভাবে জার্মান অভিবাসীরা বিপ্লব ঘটিয়েছে
ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থার অ্যাটর্নি নরিস বলেছেন, সান আন্তোনিওতে সোমবারের ট্র্যাজেডি থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুসহ এক ডজনেরও বেশি অভিবাসী অপরাধের শিকার বা সহযোগী সাক্ষী অভিবাসীদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনি আবাস প্রদানকারী ভিসার জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
কিন্তু ‘শিরোনাম ৪২’ চালুর কারণে কিছু যোগ্য অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই অভিবাসন সুবিধাটি ব্যবহার করা আরো কঠিন হতে পারে। করোনার সময়কার স্বাস্থ্য আদেশ বাইডেন প্রশাসন ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২ মিলিয়নেরও বেশি বার ব্যবহার করেছে। যা আশ্রয়-সহ সাম্প্রতিক সীমান্ত অতিক্রমকারীদেরকে অবিলম্বে বহিষ্কার করতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার অভিবাসন অ্যাটর্নি টেলর লেভি বলেছেন, সম্ভবত জীবিত অভিবাসীদের তদন্তের সময় ফেডারেল হেফাজতে রাখা হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে।
সূত্র: টেক্সাস ট্রিবিউন