বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আনুমানিক ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বর্তমানে দেশের সাত জনের মধ্যে প্রায় একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ এবং এর প্রভাবে ইতিমধ্যে ৭.১ মিলিয়ন মানুষ হারিয়েছেন তাদের জীবিকা, পেশা ও বসতভিটা।
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২১ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। একইসঙ্গে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলির মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে দেশটি।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বন্যা, উপকূলীয় ও নদীর তীরের ভাঙ্গন, অতিখরা/ অতি বৃষ্টি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এবং ভূমিধসসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগের জন্য দেশটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুর্যোগগুলির কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, লক্ষাধিক বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ এবং জীবিকা ব্যাহত হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কক্সবাজারে গত ২০ বছরে প্রায় ৮০% পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছেন। যার ফলে প্রাণহানিসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং জীবিকার সুযোগ উত্তরোত্তর হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আনুমানিক ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বর্তমানে দেশের সাত জনের মধ্যে প্রায় একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ এবং এর প্রভাবে ইতিমধ্যে ৭.১ মিলিয়ন মানুষ হারিয়েছেন তাদের জীবিকা, পেশা ও বসতভিটা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আনুমানিক অর্ধ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায় সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি যদি সহসাই কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার স্থলভাগের প্রায় ১০%-১৫% পর্যন্ত হারাতে পারে।
আরো পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রশমনে প্রয়োজন রেমিট্যান্সের কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের ঝুঁকিগুলোকে সাধারণত তিনভাবে চিহ্নিত করা যায়: অপেক্ষাকৃত নিচু বা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের বসতি, জলবায়ু-সংবেদনশীল জীবিকা এবং নিরাপদ ও সেচযোগ্য পানির সংকট।
উপকূলীয় অঞ্চলে আবাদি জমি ও সেচের পানি উৎসে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছাসের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা প্রভাবক বাংলাদেশের প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বাস্তুচ্যুতি ও নগরকেন্দ্রিক বা বিদেশে শ্রম অভিবাসনের প্রধান নিয়ামক হিসেবে ধরা হয়।
বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী এবং কক্সবাজারসহ বেশকিছু জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
খরা, অতিবৃষ্টি, সেচ এবং পানযোগ্য পানির স্বল্পতা জনগণকে তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরে অভিবাসন করতে বাধ্য করেছে।
অতিবৃষ্টি বা ভারীবৃষ্টির কারণে ভূমিধসের ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে মানুষ যেমন একদিকে যেমন গৃহহীন হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে বন্যায় নদীর তীর ও উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র সৈকত ভাঙন বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করেছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ব্যাপক অভিবাসনের কারণে নগর জীবনে আজ আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির সংকট বেশ তীব্র হচ্ছে। ইউএন উইমেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় ৭০% এরও বেশি অভিবাসী ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধির কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আগত।
জীবিকার ও সুপেয় পানির উৎস হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের দক্ষতা ঘাটতির জন্য পুরুষদের তুলনায় নারীদের আজ অনিরাপদ অভিবাসন ও পাচারের ঝুঁকির সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি শীর্ষস্থানীয় সংস্থা বমসা (BOMSA)-ইইউ (EU) এবং অক্সফাম বাংলাদেশ (Oxfam In Bangladesh) সমর্থিত একটি প্রকল্প ঢাকায় অবস্থানরত গৃহকর্মীদের উপরে জরিপকর্ম বাস্তবায়ন করে। যেখানে দেখা যায়, এসব গৃহকর্মীর প্রায় ৮০% বিগত ৪-৫ বছরে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল যেমনঃ ভোলা, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, গাইবান্ধা এবং বরিশাল হতে ঢাকায় জীবন ও জীবিকার তাগিদে অভিবাসন করতে বাধ্য হয়েছেন।
আরো পড়ুন: অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও অভিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ জেলা এবং সংকটের প্রকৃতি
বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনস্থ স্থানীয় সরকার জলবায়ু পরিবর্তন উদ্যোগের (এলওজিআইসি) ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স (সিভিআই) অনুসারে পটুয়াখালী (সিভিআই ০.৫৭), বান্দরবান (সিভিআই ০.৫৫), ভোলা (সিভিআই ০.৫৩), বরিশাল (সিভিআই ০.৫৩), রাঙ্গামাটি (সিভিআই ০.৫৩), গাইবান্ধা (সিভিআই ০.৫৩), খুলনা (সিভিআই ০.৫২), কক্সবাজার (সিভিআই ০.৫২), বাগেরহাট (সিভিআই ০.৫২), এবং নেত্রকোনা (সিভিআই ০.৫২) দেশের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
প্রতি বছর এসব জেলা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা এবং চরম বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা জেলা থেকে জেলায় ভিন্ন হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মোট ১১ টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আর্থিক হিসেবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ ৭৯ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
তাৎক্ষণিক আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি, উপকূলীয় ও নদী ভাঙন অঞ্চলে বিপর্যয়কর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি করে এবং প্রতি বছর গড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কর্মহীন অবস্থায় রাখে।
এই দুর্যোগের কারণে শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং নারীরা অসমভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্থ হয়। এছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠী কর্মহীন বা বেকার হয়ে পড়ে এবং অতি দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হয়।
জলবায়ু এবং চরম দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল থেকে শ্রম অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের চিত্র
মূলত বন্যা, নদী ভাঙ্গন এবং সমুদ্রের লবন পানির অনুপ্রবেশের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী প্রায়শই স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আবাদি জমি ও বসতভিটা ও অন্যান্য সম্পত্তি নদীগর্ভে বা সমুদ্রে বিলীন হয়।
এমনকি এই দুর্যোগসমূহ তাদেরকে বিদেশে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করতে পুশ ফ্যাক্টর (Push Factor) হিসেবে কাজ করে। ২০১৮ হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) জেলাভিত্তিক উপাত্ত (ডাটা) বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, কোভিড-১৯ মহামারী সময়কাল (২০২০- ২০২১) ব্যতিত জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলি থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জীবন ও জীবিকার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেই নির্দেশ করে।
আমরা যদি বিএমইটির উপাত্ত বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে: ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের ভিতর পটুয়াখালীতে বিদেশে শ্রম অভিবাসনের হার ২.০৪ গুণ, ভোলায় ২.৪৯ গুণ, কক্সবাজারে ২.৮৩ গুণ এবং বাগেরহাটে ২.২১ গুণ বেড়েছে। কিন্তু, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস জেলা হিসেবে বিএমইটির তালিকাতে স্থান পাওয়া কক্সবাজার ছাড়া জলবায়ু ঝুঁকিতে আক্রান্ত অধিকাংশ জেলা আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের তালিকার তলানিতে রয়েছে। উপরন্তু, দক্ষতা উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসন এবং বিদেশে শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ এই জেলাগুলির জন্য অপর্যাপ্ত বললেই চলে।
আরো পড়ুন: অভিবাসীর বাজেট : প্রত্যাশা, সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা
শ্রম অভিবাসন কেন হয়?
বিগত দুই দশক ধরে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই জেলাগুলিতে শস্য-ফসল চাষ, মৎস্যচাষ এবং গবাদি পশুর পালনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে।
উপরন্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বসতভিটা, গবাদি পশু ঘর এবং মাছের পুকুরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। যার ফলে প্রতি বছর ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং অভিযোজিত না হতে পেরে জীবিকার বিকল্প উপায় খুঁজতে তারা বাধ্য হন।
যদিও ২০টিরও অধিক এনজিও এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান এই উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজনে কাজ করছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ এই প্রক্রিয়াটিকে তাদের আর্থ-সামাজিক চাহিদা মেটাতে অপর্যাপ্ত ও ধীরগতির বলে মনে করেন।
আমাদের দেশে সাধারণত, শ্রম অভিবাসন ও বিদেশে কর্মসংস্থানকে দ্রুততম উপায়ে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য যৌক্তিক উপায় হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। যা উল্লেখযোগ্যভাবে আর্থ-সামাজিক রূপান্তরণে সক্ষম।
ধারণা করা হয়, বিদেশে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান ও অবস্থান পরিবারের ও ব্যক্তির আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিবাসী পরিবারগুলি উচ্চ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অর্থের বিনিয়োগ করতে পারেন ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যদের তুলনায় বেশি ব্যয় করতে পারেন।
এছাড়াও, সম্প্রতি দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মাঝে মাঝে অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তা প্রদর্শন করেছে, যা ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ব্যক্তিগত জীবন উভয়কেই ব্যাহত করছে। ফলস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও দেশে জীবিকার বিকল্প হিসেবে শ্রম অভিবাসন এবং বিদেশে কর্মসংস্থানকে বেছে নিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগ্রস্থ অঞ্চল থেকে শ্রম অভিবাসন: প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
নিরাপদ শ্রম অভিবাসনে সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম: সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বিএমইটি (BMET), ডেমো (DEMO), কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (PKB) এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহ শ্রম অভিবাসনকে নিরাপদ, নিয়মিত এবং সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান করে থাকে। যদিও তা কুমিল্লা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং ঢাকার মতো অভিবাসন-প্রবণ জেলাগুলিতেই বেশি কেন্দ্রীভূত।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এসব জেলায় ওয়ারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ), ব্র্যাক, রামরু, বমসা এবং প্রত্যাশীসহ ১০টিরও বেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এই জেলাগুলিতে প্রাক-অভিবাসন বা প্রাক-সিদ্ধান্তগ্রহণ ও আইনি সহায়তা সেবা প্রদান করছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো অভিবাসী পরিবারের আর্থিক সাক্ষরতা, কারিগরী দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বীকৃতি এবং বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীর পুনর্বাসনে প্রত্যক্ষ ও রেফারাল পরিষেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি এবং প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। তবে ভোলা, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী এবং বাগেরহাটের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় এই সংস্থাগুলির কোনোটিই উল্লেখযোগ্যভাবে সক্রিয় নয়।
মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং বেসরকারী খাত প্রদত্ত পরিষেবা
অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য এই জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলিতে খুবই কম এনজিও এবং বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নের প্রকল্প (Project) চলমান রয়েছে, যেমন: নিরাপদ অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেনতন করা, প্রাক-কর্মসংস্থান সম্পর্কে ওরিয়েন্টেশন প্রদান, বিএমইটিতে (বৈদেশিক চাকুরী প্রার্থীদের) নিবন্ধন, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, প্রাক-বহির্গমন ওরিয়েন্টেশন/ প্রশিক্ষণ, নিরাপদ অভিবাসন প্রক্রিয়া ও ধাপ সম্পর্কে জ্ঞাতকরণ (পাসপোর্ট আবেদন, ভিসা চেকিং, অভিবাসনের লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ, কাজের অবস্থা/কাজের পরিবেশ, গন্তব্য দেশের আইন-রীতি-সংস্কৃতির চর্চা), কাউন্সেলিং সহায়তা, কল্যাণমূলক পরিষেবা প্রাপ্তিতে সহায়তা করা (আইনী সহায়তা, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা এবং জরুরি আর্থিক সহায়তা, অভিবাসীর সন্তানদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে পুনর্বাসন ঋন প্রাপ্তিতে সহায়তা, প্রবাসী কর্মীর মৃতদেহ পরিবহন, জীবন বীমা এবং অভিযোগ ব্যবস্থাপনা)।
যদিও ইউএসএআইডি (USAID) এবং সুইস ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (SDC-এসডিসি) এর কিছু অংশীদার উপকূলীয় জেলা যেমন: যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে কাজ করেছে মানব পাচার প্রতিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজিত হওয়া ইত্যাদি নিয়ে।
আরো পড়ুন: ‘হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে কত শত প্রবাসীর মরদেহ স্বজনদের বুঝিয়ে দিয়েছি, তার হিসাব নেই’
কিন্তু এসব জেলা থেকে বিদেশে দক্ষ কর্মীর অভিবাসনের জন্য এখন পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অধিকন্তু, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এর মতো ডিজিটাল/প্রযুক্তিগত পরিষেবা প্রদানকারীরাও এই বিষয়ে (যেমন: আমি প্রবাসী অ্যাপ ব্যবহার, বিএমইটি জব সিকার্স রেজিস্ট্রেশন, অনলাইন ভিসা চেকিং, BMET-তে অনলাইন অভিযোগ জমা দেওয়া ইত্যাদি) যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নয়।
দুঃখজনকভাবে, বিভিন্ন অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি বা পাচারকারীদের দালাল এই অঞ্চলগুলিতে অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে। অন্যদিকে দেখা গিয়েছে, ভিজিলেন্স টাস্ক ফোর্স (ভিটিএফ), মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি (CTCs) এবং জেলা প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত আইনি পদক্ষেপসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পর্যবেক্ষণের ঘাটতিও এই সব জেলার বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক শ্রম অভিবাসন ও পাচারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
(চলতি নিবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তি আগামীকাল প্রকাশ করা হবে)
লেখক: আমিনুল হক তুষার, শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী এবং রওনক আরা পারভীন সহকারী অধ্যাপক, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।