বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

জোরপূর্বক অভিবাসন এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

একদল মানুষ যখন কোথাও যুদ্ধ, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন সেখানকারই আরেকদল মানুষ এই যুদ্ধ, সংঘাত ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। তাদের এই পালিয়ে বাঁচার পদ্ধতিটি ফোর্সড মাইগ্রেশন বা জোরপূর্বক অভিবাসন নামে পরিচিত। বাস্তবতা হলো, বর্বরতা থেকে বাঁচতে এসব মানুষের নিজ ভূমি ছেড়ে নিরাপদ জীবনের আশায় পরদেশে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

পালিয়ে বাঁচা এসব মানুষকে যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং অভিবাসন প্রক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অভিঘাতের কারণে বেশ কিছু মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। স্ট্রেস, উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তন, মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, নতুন দেশে গিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হওয়াসহ নানা কারণে অভিবাসীরা তীব্র মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

সর্বোপরি তাদের মধ্যে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি কিংবা হারানোর ভয় প্রকট হয়ে ওঠে। তাদের জন্মভূমি আজ অন্যের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা কখনো সেখানে ফিরতে পারবেন কিনা সেই অনিশ্চয়তা সবচেয়ে পীড়াদায়ক হয় তাদের জন্য।

এ ধরনের অভিবাসনের কারণ অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেজন্যই তারা যখন নতুন দেশে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সম্মুখীন হয় তখন তাদের মানসিক সমস্যা বেড়ে যায়। অবশ্য সেদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিজের সংস্কৃতির মিল থাকলে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি, এমনকি খাদ্যাভ্যাসের মিল থাকাটা এসব ক্ষেত্রে খুবই উপকারী হয়।

অন্যদিকে, অভিবাসনের পর চাকরি এবং সামাজিক মর্যাদা হারানো তাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের তীব্র অভাব অনুভূত হয়। অভিবাসীরা হয়তো সচেতনভাবে উপরোক্ত সমস্যাগুলো অনুভব করতে ব্যর্থ হতে পারেন, তবে এসবের কারণে তাদের মধ্যে মানসিক কষ্ট, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, সাইকোসোমাটিক সমস্যা, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, সহিংসতা বা ক্রোধের- বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।

এমনকি অভিবাসনের কয়েক দশক পরও ব্যক্তির উপর এর প্রভাব দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে, তাদের জন্য পেশাদার সেবা ব্যবস্থা অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, আমরা ব্যথার মুখোমুখি হলেই নিরাময়ের উপায় খুঁজে পেতে পারি।

শিশুদের উপর প্রভাব

সংঘাতের কারণে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হওয়া পরিবারের শিশুদের উপর যুদ্ধের মানসিক প্রভাব দ্রুত মূল্যায়ন করা উচিত। এটি অত্যাবশ্যকীয়, কারণ আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে সমাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে এবং এজন্য তারা যে মানসিক সমস্যাগুলির মধ্য দিয়ে গেছে তা নিরাময় করা দরকার।

যুদ্ধ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং সহিংসতার মতো অভিজ্ঞতাগুলো শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওরপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা যেমন ভয়, অন্তর্মুখিতা, রাগ এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায়।

অভিবাসনের আগে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েরই মানসিক ও শারীরিক সহিংসতা, গণহত্যা, মৃত্যুকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা, প্রিয়জনদের ক্ষতি, ধ্বংস, মারপিট, লুটপাট, অপহরণ, দারিদ্র্যতা এবং নানা অভিঘাত তাদের মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ায়। অভিবাসনের সময় বা পরবর্তীতে তাদেরকে প্রায়ই আইনি জটিলতা, গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকি, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ, ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং সংস্কৃতির ধাক্কা মোকাবেলা করতে হয়। তাদের মনে সবসময় এই আঘাতের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। আদতে দেখা যায়, তারা যেসব অনুভূতি, অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাদের বারবার সেসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।

যে শিশুরা সরাসরি যুদ্ধ, তীব্র সহিংসতা, গুন্ডামি এবং মারপিটের সম্মুখীন হয়েছে, যদি তারা প্রয়োজনীয় মানসিক সহায়তা না পায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, যা একসময় তারা এড়িয়ে গিয়েছিল।

আশ্রয়দাতা দেশ

অভিবাসন ও এর ফলে সৃষ্ট সব সমস্যাকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হিসাবে সাধারণীকরণ করা যেতে পারে। তবে এর ফলে একদিকে অভিবাসীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি আশ্রয়দাতা দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও তা প্রভাব ফেলে। কারণ, অভিবাসীদের সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিও স্থানান্তরিত হয়।

যেহেতু অভিবাসনের ফলে তারা আশ্রয়দাতা দেশের অংশ হয়ে ওঠে, তাদের মানসিক সমস্যাগুলোও সেই সমাজে প্রবাহিত হয়। আশ্রয়দাতা সমাজ মনে করতে পারে, তার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়েছে। অভিবাসী সমাজের বহুবিবাহ, তালাক ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনাগুলো হোস্ট সম্প্রদায়ের জন্য তীব্র চাপ তৈরি করে। তারা ভাবতে পারে যে, তাদের পারিবারিক কাঠামো, তাদের নারী ও শিশুরা হুমকির সম্মুখীন।

অভিবাসীদের আগমন হোস্ট সোসাইটির স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপ বাড়ায় এবং স্বাস্থ্য খাত জনবলের অভাবে ভুগতে পারে। তাছাড়া, স্থানীয় লোকেরা বেকারত্বের সম্মুখীন হতে পারে, কারণ অনেকক্ষেত্রে অভিবাসীরা কম মজুরিতে কাজ করে।

এই সমস্ত কারণগুলি আশ্রয়দাতা সমাজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং জাতিগত বিদ্বেষের সূচনা করে। এধরনের জটিলতা এড়াতে উভয় পক্ষেরই উচিৎ নিজেদের ওপর অভিবাসনের প্রভাব বোঝা এবং এটা একে অপরকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে৷

কী করা যেতে পারে?

অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য, তাদের জীবনযাত্রা এবং তারা যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হয় তা অবশ্যই পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা মূল্যায়ন করা উচিত। তাদের আবাসন, পুষ্টি এবং নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পর সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অভিবাসন সমস্যা মোকাবেলার প্রথম ধাপেই অভিবাসী ও হোস্ট সোসাইটির সদস্যদের জন্য এ ধরনের সেবা প্রদান থাকা প্রয়োজন।

সমস্যাগুলোকে দমন করার চেষ্টা না করে, উভয় পক্ষের সমস্যাগুলোকেই আমলে নেওয়া দরকার। এর ফলে পারস্পরিক বিদ্বেষ তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যায় এবং এতে পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসের অনুভূতি তৈরি হয়।

বিশ্বায়নের ফলে মানুষের মধ্যে যেমন একীকরণ ও এককেন্দ্রিকতা তৈরি হয়, তেমনি বিপরীতভাবে অনেকে এটাকে তার আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি রক্ষায় জোর দেয়। এটাই স্বাভাবিক অবস্থা। তবে তাদের বোঝা উচিৎ, ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণ মানেই নিজের পরিচয় হারানো নয়।

অভিবাসীরা যারা তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখে এবং আশ্রয়দাতা সমাজের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানগুলি গ্রহণ করে – যেমন স্থানীয় ভাষা, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য – এবং এই জ্ঞান তাদের সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করে তারা নিজেদেরকে আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে।

অভিবাসী এবং হোস্ট সম্প্রদায় যদি নিজেদের মধ্যে সংস্কৃতির বিনিময় করে, যেমন খাদ্য, ধর্ম, রীতিনীতি এমনকি তাদের স্থানীয় ভাষায় অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করে তাহলে তাদের বন্ধন শক্তিশালী হবে এবং পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করবে।

আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ অবশ্যই জোরদার করতে হবে। অভিবাসী এবং হোস্ট সোসাইটির সদস্যরা তাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতি ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উপকৃত হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আচরণের ধরণ, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, সম্মান এবং সহানুভূতি, সামাজিক জীবন, বৈচিত্র্য এবং অনিশ্চয়তার প্রতি তাদের সহনশীলতা।

অভিবাসী এবং হোস্ট সোসাইটির মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ এড়িয়ে যেতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। মনে রাখতে হবে, আস্থাপূর্ণ বন্ধন এবং সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই অভিবাসনের ক্ষত ও অভিঘাতগুলোকে নিরাময় করবে।

লেখক: সেয়মা কোচাক, সাইকোথেরাপিস্ট, তুরস্ক। ডেইলি সাবাহ-এ প্রকাশিত নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন মাহামুদ সেতু, পাবলিক হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট।

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা