অনিয়মিত উপায়ে যুক্তরাজ্যে আগত শরণার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর পরিকল্পনা নানারকম সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে আটক শরণার্থীদের মধ্যে যাদের রুয়ান্ডায় নির্বাসন দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে, তারা সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, অমানবিক এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা অনশনে রয়েছেন। একারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ শারীরিকভাবেও গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে সরাসরি হুমকি দিয়ে শরণার্থীদের অনেকে বলেছেন, যদি রুয়ান্ডায় নির্বাসিত করা হয়, তাহলে ‘আমরা আত্মহত্যা করবো’।
গত এপ্রিলে যুক্তরাজ্য আফ্রিকান দেশটিতে অফশোর আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত উপায়ে প্রবেশকারীদের নির্বাসিত করার প্রথম ফ্লাইট আগামীকাল যাত্রা করবে।
সিরিয়ার নাগরিক আহমেদ নামের একজন বলেন, সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করার পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং নথি ছাড়াই যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। ফলে প্রথম ফ্লাইটেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে। লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের কাছে কলনব্রুক ইমিগ্রেশন রিমুভাল সেন্টারে আটক ২০ বছর বয়সী এই যুবক ফোনে আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘আমি পালিয়ে গিয়ে বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছি।’ দুর্ভাগ্যবশত ২০ মে, হোম অফিস আমাকে তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করেছে এবং আমাকে রুয়ান্ডায় একটি টিকিট ধরিয়ে দিয়েছে।’
আরো পড়ুন:
অভিবাসীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত যুক্তরাজ্যের
আহমেদ জানান, তাকে রুয়ান্ডায় পাঠানোর এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে তিনি অনশন করছেন। এছাড়া ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকা স্বত্ত্বেও কেন তাকে রুয়ান্ডায় পাঠানো হচ্ছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
‘আমি কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না, কেন আমাকে আফ্রিকার এমন একটি দেশে যেতে হবে, যেখানে আমার আত্মীয়স্বজন এবং পরিবার নেই। আমি সেখানকার লোকজনকে চিনি না। আমি যেতে অস্বীকৃতি জানাব, কিন্তু যদি যুক্তরাজ্য সরকার আমাকে কিগালিতে নির্বাসনের জন্য জোর দেয় এবং আমাকে জোর করে বিমানে নিয়ে যায়, তাহলে আমি নিজের জীবন নিয়ে নেব।’
ন্যায়বিচারের আন্দোলন
বিক্ষোভকারীরা কলনব্রুকের মতো অভিবাসন কেন্দ্রে নির্বাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছে। একই কেন্দ্রে ইরান থেকে ২৩ বছর বয়সী কুর্দি বন্দী ফেরহাদ বলেছেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ইউরোপীয়দের স্বাগত জানানোর সঙ্গে তুলনা করলে নির্বাসনের সম্ভাবনাও বিশেষভাবে রয়েছে সেখানে।
তিনি এতটাই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন যে, এখন যখন তিনি শুনতে পান কোনো বিমান কেন্দ্রের উপরে উড়ছে, তখন তিনি ঘাবড়ে যান। তিনি অনশনে রয়েছেন এবং তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য ১৪ জুন অর্থাৎ আগামীকাল ফ্লাইট নির্ধারিত রয়েছে।
ফেরহাদ বলেন, ‘যখন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন সমস্ত ইউক্রেনীয়কে স্বাগত জানানো হয়েছিল এবং উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু আমরা সবাই শরণার্থী সেহেতু কেন আমাকে রুয়ান্ডায় স্থানান্তর করা হবে? অথচ ইউক্রেনীয়দের স্বাগত জানানো হবে। তাদের একটি উন্নত জীবন, আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় সবকিছু দেওয়া হবে। আমাদের শেকড় যাই হোক না কেন, আমরা সবাই মানুষ। আমাকে রুয়ান্ডায় নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আমাকে এখানে মেরে ফেলুক বা ইরান আমাকে হত্যা করুক।’
আরো পড়ুন:
যুক্তরাজ্যে ৪৩ হাজারেরও বেশি পরিবার ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের আশ্রয়দানে আগ্রহী
আলজাজিরা কলনব্রুকে ১৫ বন্দীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, যেখানে ৬০ জনেরও বেশি লোককে রুয়ান্ডায় নির্বাসনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়াও লন্ডনের কাছাকাছি অন্যান্য আটক কেন্দ্রে আরো অনেককে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। আলজাজিরা সামগ্রিকভাবে কতজনকে নির্বাসিত করা হবে, তা জানতে হোম অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলো। তবে সংশ্লিষ্ট মুখপাত্র মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া তারা যেসব বন্দীর সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে আফ্রিকা থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীরাও ছিলেন।
২৫ বছর বয়সী আসিম; যিনি মে মাসের প্রথম দিকে ফ্রান্স হয়ে নৌকায় যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। কলনব্রুক থেকে ফোনে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছি। কিন্তু কিছুদিন পর ১৭ মে আমাকে রুয়ান্ডায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি সংঘাতের কারণে দারফুর থেকে পালিয়ে এসেছি। আমাকে অপহরণ করে রুয়ান্ডায় নিয়ে যাওয়া আমার মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং এর প্রতিবাদে আমি অনশন করছি।’
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, রুয়ান্ডার সঙ্গে কিগালিতে শরণার্থীদের স্থানান্তর করার জন্য বহু মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি এই ব্যবস্থাটিকে ক্রমবর্ধমান অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রক্রিয়া রোধ করার একটি কার্যকর উপায় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো দাবি করেন, ‘এটি পাচার রোধ করবে এবং ইংলিশ চ্যানেলে মৃত্যু হ্রাস করবে। ফ্রান্স এবং দক্ষিণ ইংল্যান্ডের মধ্যকার নৌপথ দিয়ে কেউ কেউ অনিরাপদ নৌকায় ব্রিটেনে পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় যে মারা গেছে, সেটাও রোধ করা সম্ভব হবে।’
যদিও বেশিরভাগ অভিবাসীদের অপসারণ করার জন্য তাদের ভ্রমণে হাজার হাজার ডলার খরচ করা হয়েছে। এপ্রিল মাসে ইউকে জাতীয়তা এবং সীমান্ত আইন প্রবর্তন সরকারকে অনিয়মিত অভিবাসীদের তৃতীয় ‘নিরাপদ’ দেশে স্থানান্তর করার অনুমতি দিয়েছে। কলনব্রুকে এ আটক ৬০ জনের মধ্যে প্রায় ২০ জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে।
আরো পড়ুন:
ফুটপাতে ঘুমানোর অধিকারও খর্ব করবে যুক্তরাজ্যের নতুন অভিবাসন নীতি!
মানবাধিকার সংগঠন এবং বিরোধী রাজনীতিকরা বলেছেন যে, নির্বাসনের পদক্ষেপ অনৈতিক। কিছু শরণার্থীর দ্বারা প্রাপ্ত হোম অফিসের নথি আলজাজিরা দেখেছে এবং ১ জুন বলা হয়েছে যে, ‘ব্যক্তিরা (শরণার্থীরা) ১৪ জুন তাদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন না।’ তারা একটি যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশ বর্ণনা করেছেন। এবং আটক ব্যক্তিদের সন্দেহজনক অবস্থার কথা বলেছেন।
তারা দাবি করেছেন, ‘কেন্দ্রের নিরাপত্তারক্ষীরা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্মার্টফোন জব্দ করেছে। এছাড়াও ইন্টারনেট অ্যাক্সেস ছাড়াই মোবাইল ফোন সরবরাহ করেছে। একজন মুসলিম বন্দী বলেছেন, ‘তিনি নিশ্চিত বোধ করেননি যে, কেন্দ্রে যে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, তা হালাল।’
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক রিফিউজি কাউন্সিল এর প্রধান এনভার সলোমন বলেছেন, ‘আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব সম্পর্কে মর্মান্তিক গল্প শুনছি, আত্ম-ক্ষতিমূলক বিষয়গুলোও আমাদের সামনে এসেছে। আমরা উদ্বিগ্ন যে, সরকার এসব ঘটনার পেছনের কারণ দেখতে পারছে না। কিন্তু দুর্বল লোকদের প্রতি সরকারের যত্ন নেওয়া দরকার এবং এ বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সূত্র: আলজাজিরা