বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জাতীয় বাজেট: অভিবাসী শ্রমিকদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

আমিনুল হক তুষার

আসন্ন জাতীয় বাজেট নিয়ে উন্নয়নকর্মীরা সরকারের সঙ্গে শুরু করেছে আলাপ-আলোচনা। এর  অন্যতম উদ্দেশ্য, প্রান্তিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন-জীবিকার (Livelihood) জন্য নিয়ামক সেবা ও পণ্যের আর্থিকমূল্য যেন সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতায় দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি (Inflation), আর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের জন্য হয়েছে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের জন্য বিনিময়যোগ্য মুদ্রার তহবিল (Foreign Currency Reserve) ঘাটতি।

বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। সরকার বহুমাত্রিক কৌশল অবলম্বন করে এই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে তার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে-যার ভেতর প্রাধান্য পেয়েছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের রিজার্ভ বাড়ানো এবং দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য রক্ষা।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির জন্য কৃষির পর গুরুত্বপূর্ণ দুইটি খাত হলো: তৈরী পোশাক শিল্প (RMG) ও রেমিটেন্স (Remittances)। বিশ্বের প্রায় ১৭০টির ও বেশি দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশিরা (সূত্র: বিএমইটি) ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক (Contractual Migrant Worker)।

বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স হিসেবে প্রেরণ করে এই প্রবাসী শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স যে শুধু তাদের পরিবারের চাহিদা মেটাচ্ছে তা নয়, বরং তার জন্য অনেক ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও উদ্যোক্তারও সৃষ্টি হচ্ছে। পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে সমাজ ও দেশের এক-চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য সরকারি উদ্যোগে কাজ করা হচ্ছে খুবই কম। জাতীয় বাজেট-এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থাৎ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্যও বরাদ্দ কম থাকে বরাবরই।

আরো পড়ুন: অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষায় নিরাপত্তা মডেল: সুযোগ ও সম্ভাবনা

বিগত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আমাদের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বেশি- যা স্বাধীনতাত্তোর দেশের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় বাজেট। ওই বাজেটের লক্ষ্যও ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু সেই বিশাল বাজেটেও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিলো মাত্র ৬৩৩ কোটি টাকা মাত্র (০.০৯৩%), যেখানে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্সে ২০২২ সালে অবদান ছিল ৪.৪৪%।

প্রবাসীদের অভিবাসন সংক্রান্ত মৌলিক ও কারিগরী সেবা প্রদানের বিষয়টি ছাড়া, তাদের কল্যাণে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই বললেই চলে। যতটুকু হয়, তাও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের (Wage Earners Welfare Board) অর্থে হয়-যা অভিবাসী শ্রমিকদের অর্থেই গঠিত।

তাছাড়া প্রবাসীদের মাঝে সমন্বয় সাধন করে তাদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে বা তাদের অধিকার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করে এমন শক্তিশালী জোট বা ফোরাম নেই বললেই চলে। একারণে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে সরকারি বরাদ্দ জাতীয় বাজেটে খুব বেশি একটা প্রাধান্য পায় না।

যদিও কিছু এনজিও এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে কিছু নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলোচনা সভা বা সেমিনার করা হয়, তারপরও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন: অনেক সংস্থাই সংসদে বাজেট উত্থাপনের এক দেড় মাস পূর্বে বিভিন্ন সেমিনার, পরামর্শ (Consultation) বা অংশীজন সভা করে থাকে- অথচ বাজেটের জন্য প্রস্তুতি সরকার আরও ২-৩ মাস পূর্ব থেকেই নিচ্ছে। ফলে, তখন বিশেষজ্ঞদের মতামত বা পরামর্শ গ্রহণ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।

আরো পড়ুন: অভিবাসীদের কল্যাণ কি শুধু অভিবাসীদের অর্থেই সীমাবদ্ধ?

আসলে, আমাদের প্রবাসীদের মাঝে জোটবদ্ধ হওয়া, সমন্বয়ের সঙ্গে দাবি পেশ করা ও তা অর্জনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের আগ্রহ কম।

সরকার মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কিছু বাজেট বরাদ্দ যদিও রাখে। কিন্তু তার সিংহভাগ খরচ হয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রকল্প/ সেবা পরিচালনা (Operational Cost), সংস্কার ও প্রশাসনিক কাজে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতিবছর বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন অবকাঠামো (যেমন: প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, বিভিন্ন অফিস বা সেন্টার স্থাপন ও সংস্কার ইত্যাদি) নির্মাণে, কিন্তু সেবা নিরবিচ্ছিন্ন করতে যে দক্ষ জনবল, বা উপকরণ বা মেশিনারিজ (Materials and Machineries) প্রয়োজন-তাতে খুবই স্বল্প বরাদ্দ রাখা হয়।

যেমন: জেলা বা উপজেলা ভিত্তিক কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি বা উপকরণ বেশিরভাগই ব্যবহার অনুপযোগী। তারপর আবার আবাসিক কক্ষ বা আবাসিক ব্যবস্থা (Residential facilities, i.e. rooms, dinning, washrooms etc.) খুব একটা যুগোপযোগী নয়। ফলে ব্যাহত হয় বিদেশগামী কর্মীদের কারিগরী বা দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ।

তাছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য নেই দেশভিত্তিক (Country wise PDT Documents) প্রশিক্ষণ উপকরণ, পাঠপুস্তক, ও দক্ষ প্রশিক্ষক। বিভিন্ন এনজিও ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আরও যে সব খাতে প্রবাসীদের সেবা ও তার জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন তা হলো: নিরাপদ অভিবাসন তথ্য ও ডকুমেন্টস প্রসেসিং সেবা, কাউন্সেলিং সেবা (কর্মসংস্থান, ট্রমা ব্যাবস্থাপনা, অর্থের বিনিয়োগ, পুনর্বাসন ইত্যাদি), প্রশিক্ষণ সেবা (কারিগরী ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন), এবং আর্থিক বিনিয়োগ (Remittance Investment) সংক্রান্ত সেবা।

বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশী অর্থাৎ ডিয়াস্পোরা কমিউনিটির (Diaspora Community) বিনিয়োগ সুবিধা বাড়াতে হবে ও তাদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

এই সেবাগুলো যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রদান করতে হবে তা কিন্তু নয়। বরং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে (সম্পদ, দক্ষ কর্মী, সেবা প্রদান প্রক্রিয়া) এবং নির্ধারিত মানদণ্ড (Standard) ও কৌশল (Strategy) অনুসরণ করে তা জেলা ও উপজেলা থেকে প্রদান করা যেতে পারে।

পাশাপাশি বৈধ উপায়ে অধিক হারে রেমিট্যান্স প্রেরণ উৎসাহিতকরণে সরকার প্রণোদনার (Incentives) হার তিন শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে ও ডিজিটাল মাধ্যমকে সম্প্রসারণ করে রেমিট্যান্স প্রাপ্তি প্রান্তিক পর্যায়ে সুলভ ও সহজলভ্য করতে পারে।

আরো পড়ুন: অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও অভিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন

শ্রম অভিবাসনের ফলে একদিকে যেমন অর্থযোগ হয়, অন্যদিকে দক্ষ জনগোষ্ঠীও তৈরী হয়। যার সুফল ভোগ করার কৌশল আমাদের জানতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন অধিকতর গবেষণা (Research) ও ম্যাপিং (Mapping) করা।

এছাড়াও শ্রম অভিবাসনের সুফল হতে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত (Climate Change Impact) প্রভাব সম্পন্ন এলাকা থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি প্রকৃতি ও সম্ভাব্যতা যাচাই করা ও দক্ষ নারী শ্রমিক তৈরী করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং এসব কর্মসূচি বা কার্যক্রম বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ দিতে হবে।

জাতীয় বাজেটে শুধু অর্থের বরাদ্দ দেখলেই চলবে না, বরং তা কীভাবে ও অগ্রাধিকারভিত্তিক কোন কোন খাতে দেয়া প্রয়োজন তাও দেখতে হবে। পাশাপাশি অর্থের স্বচ্ছ, সঠিক ও কার্যকর ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
98SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা