- বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে ‘জলবায়ু অভিবাসী’রা। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, তারা আর ত্রাণসামগ্রী চান না, নদী ভাঙনের স্থায়ী সমাধান চান
নাতিকে কোলের মধ্যে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বসেছিলেন ৭০ বছর বয়সী মোহাম্মদ সোহরাব খান। বয়সের ভারে শরীরের শক্তিটুকু ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও আগের মতো তিনি আর নদী বা সাগরে গিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। অবসরের সময়টুকু তাই তার কেটে যায় নাতি-নাতনিদের সঙ্গ দিয়ে।
নদীর কিনারায় একটি নারকেল গাছের নিচে বসে তিনি উপকূলীয় জেলা বরগুনার দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের মোহনা লাগোয়া নদীতে কি যেন খুঁজছিলেন। এর ফাঁকে তিনি তার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম আনাদোলুকে বলেন, ‘‘আমি আমার জন্মের পর থেকে এখানে বসবাস করছি। নদী আমাদের জমি, বাড়িঘর ও অন্যান্য সম্পত্তি দুই দফা গ্রাস করেছে। এখন আমি আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে রাস্তার ধারে একটি ছোট তাঁবুতে ভাসমান মানুষ হিসাবে থাকি।” তিনি নদীর দিকে এমন একটি জায়গার দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে একসময় তার একটি বড় বাড়ি, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি এবং ফসলের জমি ছিল।
আরো পড়ুন: ‘নদী ভাঙতি ভাঙতি আমাদের জীবনও ভাঙ্গি গেছে’
জনাব খানের মতো পাথরঘাটা উপজেলার জিনতলার এই এলাকায় নদী গত দুই দশকে প্রায় দুই হাজার মানুষের বাড়ি-ঘর গিলে খেয়েছে। এ প্রতিবেদন তৈরির সময় নদীর ধারে ভাঙা ঘরবাড়ি ও গাছ বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা যায়। এসময় কাছাকাছি দূরত্বে কালো পাঞ্জাবি লুঙ্গি এবং মাথায় টুপি পরা একজন লোক বিষন্ন মেজাজে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
টিনের ঘরের দিকে ইশারা করে মোহাম্মদ জাবের নামে ওই ব্যক্তি দাবি করেন, নদীর ধারের বাড়িটি একটি মসজিদ, যেখানে এই দুর্গম নদীর তীরে বসবাসকারী ধর্মপ্রাণ মানুষেরা অনেক বছর ধরে নামাজ পড়তে আসছে।
“আমি এই মসজিদের ইমাম। পতিত বাড়িটি আমার, যা দুদিন আগে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছিল। হয়ত কয়েক দিনের মধ্যেই এই মসজিদটি নদীর দখলে চলে যাবে”-জাবের বলেন।
স্থানীয় ও বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিষখালী নদীর অনেক এলাকায় লবণাক্ততা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদী ভাঙ্গন একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়ে উঠেছে।
সরেজমিনে উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গিয়ে আরো দেখা গেছে, আরেকটি বড় নদী-বলেশ্বরীতে শত শত পরিবার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে।
আরো পড়ুন: ‘জন্মস্থান এখানে না, তাই বিদেশি বলে গালি দেয় সবাই’
“মাত্র কয়েক বছর আগে, এখানে একটি বড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কংক্রিটের মসজিদ, ২০০টিরও বেশি বাড়ি এবং একটি বড় পুকুর ছিল। কিন্তু সবই নদীর পেটে চলে গেছে,” পদ্মার শুলিজ নামের ওই এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন নদী রক্ষা বালির বস্তা ওপর দাঁড়িয়ে আনাদোলুকে বলেন।
তিনি আরও বলেন, ওইসব নিঃস্ব পরিবারগুলোর অধিকাংশই এখন গৃহহীন এবং তাদের অনেকেই রাস্তার ধারে বসবাস করে আবার কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিহীনদের আবাসন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সরকারি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তারা আর ত্রাণসামগ্রী চান না, নদীভাঙন ও লবণাক্ততার স্থায়ী সমাধান চান।
কংক্রিট বাঁধ
স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি বিশ্লেষকরা মূল্যায়ন করেছেন যে, কংক্রিটের ব্লকসহ শক্তিশালী বাঁধ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
“এটি আমাদের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। কিন্তু আমাদের নিজেদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। এই ধ্বংসাত্মক নদী ভাঙ্গন বন্ধ করার জন্য সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং কংক্রিটের ব্লক স্থাপন করা উচিত”-বলেন পাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের একজন সাবেক চেয়ারম্যান।
সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় বর্তমানে চার কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে।
আরো পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি ৩ জনের একজন বাস্তুচ্যূত হবে!
বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে, বৈশ্বিক নির্গমনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে বাংলাদেশ ৭ নম্বরে রয়েছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় ভূমির প্রায় ১৭ শতাংশ নিমজ্জিত হবে। এর ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যূত হবে।
জলবায়ু প্ররোচিত অভিবাসন
আনাদোলুর সঙ্গে কথা বলার সময় কোস্ট ফাউন্ডেশন এনজিও-এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শ্রীলঙ্কা এবং নেদারল্যান্ডসের মতো বাংলাদেশের উচিত অভিবাসন বন্ধ করতে উপকূলীয় এলাকায় কংক্রিটের ব্লক দিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা। চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের উচিত যথাযথ কাগজপত্রসহ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে এই বিষয়টি উত্থাপন করা, যাতে উন্নত দেশগুলো, যারা কার্বন নিঃসরণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য প্রধানত দায়ী, তারা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু-সহনশীল সুবিধার উন্নয়নের ব্যয় ভাগাভাগি করে নিতে পারে।”
ফারাক্কা বাধের প্রভাব
এদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী আনাদোলুকে বলেছেন যে, অভিন্ন নদী গঙ্গার (বাংলাদেশের পদ্মা) উপর ভারতের তৈরি ফারাক্কা বাধ পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং নদীর প্রবাহে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। চৌধুরী বলেন, ‘‘ফারাক্কা বাধের কারণে, গ্রীষ্ম বা শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমে যায়, যার ফলে নদীর তলদেশে পলি জমা হয়, আবার বর্ষাকালে পানি উপচে পড়ায় ক্ষয় হয়।’’
বাধকে মানবসৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পলি সঞ্চালন করে না বরং ভারতের অভ্যন্তরে উজানের অঞ্চলকেও প্রভাবিত করে।
আরো পড়ুন: জলবায়ু অভিবাসনের হটস্পট হতে যাচ্ছে ঢাকা!
“আমি ভারতের কিছু পরিবেশবিদদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তারা আমাকে এই ফারাক্কা বাধের কারণে বিহার, মুর্শিদাবাদ এবং ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চলে পলি জমার বিষয়ে অবহিত করেছেন।” চৌধুরী এসময় আরো বলেন, বাংলাদেশের অনেক নদী রক্ষা করতে এবং লবণাক্ততা কমাতে এই বাঁধ ভেঙে ফেলতে হবে। তিনি দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরিবেশগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এ বিষয়ে সংলাপ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার উভয় দেশের কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান।